শুক্রবার, ৭ জুন, ২০১৩

বাংলাসাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রথম কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-৫৯)।

বাংলাসাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয় উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে। এই যুগের প্রথম কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-৫৯)... মধ্যযুগের সর্বশেষ কবি রায়গুনাকর ভারতচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৬৭০ খ্রীষ্টাব্দে, আবার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আধুনিক যুগের রূপ ফুটে উঠে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। এ সময়টি শুরু হয় মোটামুটিভাবে ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে। মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের সূচনা এই দুই যুগের মধ্যবর্তী সময়টাতে বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে তেমন কোন উৎকর্ষপূর্ণ সৃষ্টি বা সৃষ্টি সম্ভারের প্রাচুর্য দেখা যায় না। এই সময়টা বাংলা গদ্যের উদ্ভবকাল। গদ্য তখনও সাহিত্যের যথার্থ বাহনের উপযোগিতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। এই সময়ের সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যেই বিরাজমান ছিল যুগ সন্ধির বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বর গুপ্তের কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল এই সময়ে। তাই বাংলা সাহিত্যে তিনি যুগসন্ধিক্ষণের কবি হিসেবে পরিচিত। এই সময়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে ঈশ্বর গুপ্ত ছাড়া আর কারো বৈচিত্রপূর্ণ রচনাসম্ভার দেখা যায় না। বাংলা সাহিত্যের মধ্য ও আধুনিক যুগের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে সব্যসাচীর মত দুহাতে দুদিকের নির্দেশ দিয়েছেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। এই সময়ের একমাত্র খ্যাতিমান কবি তিনি। অর্থাৎ মধ্যযুগের অবসানের পর এবং আধুনিক যুগের প্রকৃত সূত্রপাতের পূর্বে কবি ঈশ্বর গুপ্ত কাব্য সাধনায় খ্যাতিলাভ করেন। 
তার সাহিত্যসাধনার সূত্রপাত হয় ১৮৩১ সাল থেকে
সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রধান লেখক।
উনিশ শতকের প্রারম্ভ থেকেই সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুনত্ব দেখা দেয়। তখন দেশীয় সমাজ ও জীবন অবলম্বন করে সাহিত্যসাধনার প্রেরণা আসে। সাময়িক পত্রিকা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাহিত্যে আধুনিকতার সৃষ্টি করা সহজতর হয়। সাময়িক পত্র অবলম্বন করে বাংলা গদ্য যেমন একটা উৎকর্ষের পর্যায়ে অগ্রসর হয়, তেমনি বাংলা কবিতাও নতুন পথের সন্ধান লাভ করে।
সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার মাধ্যমে কবি ঈশ্বর গুপ্ত এই যুগচেতনা রূপায়িত করেন। কিন্তু তার নিজের পক্ষে এই পথরেখায় বিচরণ করা সম্ভব হয় নি। কবিওয়ালাদের অনুবর্তন করে তিনি কাব্যক্ষেত্রে আর্বিভূত হন। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য এবং তৎকালীন অতীতমুখী পরিবেশ তাঁর পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব হয় নি। পক্ষান্তরে, ইংরেজি শিক্ষাসভ্যতাকে তিনি স্বাগত জানাতেও ব্যর্থ হন।
ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিনয় ঘোষ
সামিয়ক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, বাংলার নবযুগের এই দ্বন্দ্বমুখর সন্ধিক্ষণে যুবক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যখন সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা প্রকাশ করেন.......... তখন রক্ষণশীল, উদারপন্থী ও চরম বামপন্থী-হিন্দু সমাজের এই তিনটি প্রধান দলের মধ্যে স্বভাবতই তার পক্ষে প্রথমটির দিকে বেশি ঝুঁকে পড়া নিরাপদ ছিল। ব্রহ্মসভাপন্থী বা হিন্দু কলেজের নব্যশিক্ষিত ইয়ং বেঙ্গল দল- সমাজের এই দুই গোষ্ঠীর কোনটিতেই প্রবেশাধিকার লাভের যোগ্য শিক্ষা বা আর্থিক সঙ্গতি তাঁর ছিল না। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি বৈদ্যপরিবারে তাঁর জন্ম এবং আবাল্য গ্রাম্য পরিবেশেই তিনি প্রতিপালিত। তাই ১৮৩১ সালে সামাজিক ঘূর্ণাবর্তে বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদ বা পাশ্চাত্য ভাবোন্মত্ততা, কোনটাই তাঁর পক্ষে সহজপাচ্য ছিল না। সহজ ছিল হিন্দু সমাজের সাধারণ জনস্রোতে (যা অবশ্যই রক্ষণশীল) কিছু দূর ভেসে যাওয়া। প্রভাকরের প্রথম পর্যায়ে দেখা যায়, বেশ খানিকটা এই জনস্রোতে তিনি ভেসে গিয়েছিলেন। তবে অচৈতন্যের মত একেবারে যে তিনি গা ভাসিয়ে দেননি, তা অল্পকালের মধ্যেই সামাজিক মতামতের ক্ষেত্রে তার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে বোঝা যায়।... তিরিশের গোড়ার দিকে ব্রহ্মবাদী ও পাশ্চাত্যবাদীদের শ্লেষাত্মক সমালোচনায় তিনি প্রবৃত্ত হয়েছেন এবং তাতে সনাতনবাদীরা হয়ত লাভবান হয়েছেন, কিন্তু তাঁকে একেবারে উদরসাৎ করতে পারেন নি।.... চল্লিশ থেকে প্রভাকর স্বতন্ত্র উদারপন্থী হিন্দু মধ্যবিত্তের মুখপত্র রূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে।
ঈশ্বর গুপ্ত অজস্র কবিতা রচনা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম ঈশ্বর গুপ্তের
কবিতা সংগ্রহ দীর্ঘ ভূমিকাসহ প্রকাশ করেন। তবে অশ্লীলতার কারণে সব কবিতা তিনি সংগ্রহ করেন নি। তার অন্যান্য রচনা হচ্ছে ঃ কালীকীর্তন, রামপ্রসাদ সেন লিখিত, ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত; কবিবর ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের জীবনবৃত্তান্ত; প্রবোধ প্রভাকর; নিজস্ব কবিতার সঙ্কলন, হিত-প্রভাকর- হিতোপদেশের গল্প গদ্যপদ্যে রচিত; মহাকবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহাশয়ের বিরচিত কবিতাবলীর সারসংগ্রহ- কবিভ্রাতা রামচন্দ্র গুপ্ত কর্তৃক সংবাদ প্রভাকর থেকে সংগৃহীত কবিতার খন্ড খন্ড সঙ্কলন, বোধেন্দুবিকাশ নাটক; সত্যনারায়ণের ব্রতকথাপত্রিকা সম্পাদনাঃ সংবাদ প্রভাকর সংবাদ-রতœাবলী পাষন্ড পীড়ন সংবাদ সাধুরঞ্জন।
রচনায় বৈচিত্র থাকলেও ঈশ্বর গুপ্ত কবি হিসেবেই পরিচিত। তার কবিতার সংখ্যা যেমন অগণিত, তেমনি বিষয়ের বৈচিত্রও কম নয়। বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাগুলোকে বিষয়ানুযায়ী কয়টি ভাগে বিভক্ত করেছিলেনঃ
পারমার্থিক ও নৈতিক বিষয়ক কবিতা সামাজিক ও ব্যঙ্গপ্রধান কবিতা, রসাত্মক কবিতা যুদ্ধ বিষয়ক কবিতা. ঋতুবর্ণনা প্রধান কবিতা বিবিধ বিষয়ক কবিতা, শকুন্তলার কাহিনী নিয়ে রচিত কবিতা, সারদা-মঙ্গল বা উমা-মেনকার প্রসঙ্গে কবিতা কাব্যকানন, রসলহরী কবিতাগুচ্ছ
সামাজিক ও ব্যঙ্গকবিতাগুলোর জন্য ঈশ্বরগুপ্তের সর্বাধিক খ্যাতি। তার রঙ্গরসপ্রবণতা ও লঘু চপলভঙ্গি কবিতাগুলোকে উৎকর্ষ দান করেছে। সে আমলে ইংরেজি শিক্ষাসভ্যতার সংস্পর্শে বাঙালির সমাজ ও জীবনে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল ঈশ্বরগুপ্ত তাকে কবিতার উপজীব্য করেছেন। যেখানেই সামাজিক অনাচার, চারিত্রিক দৈন্য ও আদর্শহীনতা দেখেছেন সেখানেই তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি প্রাচীন-নবীনের কোন পার্থক্য করেননি। তাঁর সমাজসংক্রান্ত কবিতার বিষয়বস্তু ও ছিল বৈচিত্রপূর্ণ। যেমনঃ বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা, কৌলীন্যপ্রথার অপকারিতা, খ্রিষ্টধর্মের ব্যাপক প্রসারে আশঙ্কা, বাঙালির সাহেবিয়ানা- অনুকরণ-প্রিয়তা এবং দেশীয় আচারপ্রথা ও গুরুপুরোহিতে অবজ্ঞার জন্য ক্ষোভ, স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে সমাজে বিকৃতি ও প্রাচীন সনাতন স্ত্রীধর্ম লোপের আশঙ্কা, দেশে ব্যাপক গোহত্যা এবং সে কারণে দুগ্ধাভাব, স্নানযাত্রা উপলক্ষে জমিদারের অনাচার-ব্যভিচারের বর্ণনা, খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ, বাঙালিদের প্রতি সাহেবদের উপেক্ষা, ইয়ং বেঙ্গলদের ক্রিয়াকলাপে অশ্রদ্ধা, নীলকর সাহেবদের অত্যাচার- অবিচার। এসব বিষয় থেকে প্রমাণিত হয় যে ঈশ্বর গুপ্ত যুগের পরিবর্তনকে মেনে নেননি।
ঈশ্বরগুপ্ত ব্যঙ্গকবিতার জন্য যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তার গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। কবিওয়ালাদের জন্য সখীসংবাদ লিখে সমকালে তিনি খ্যাতিমান হয়েছিলেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ করে তিনি যে প্রতিভার পরিচয় দিয়ে গেছেন তাই তার নাম বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল করেছে। প্রাচীন কবিগণের জীবনী সংগ্রহ করে তিনি যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন তার গুরুত্বও কম নয়।
ইংরেজদের আচার আচরণকে এ দেশের জন্য অকল্যাণকর মনে করে ইংরেজিয়ানা প্রীতির ব্যঙ্গ করেছেন
ইংরেজি নববর্ষ কবিতায়ঃ 
গোরার দঙ্গলে গিয়া কথা কহ হেসে।
ঠেস মেরে বস গিয়া বিবিদের ঘেঁসে॥
রাঙ্গামুখ দেখে বাবা টেনে লও হ্যাম।
ডোন্ট ক্যার হিন্দুয়ানী ড্যাম ড্যাম ড্যাম॥
পিঁড়ি পেতে ঝুরো লুসে মিছে ধরি নেম।
মিসে নাহি মিস খায় কিসে হবে ফেম?
শাড়িপরা এলোচুল আমাদের মেম।
বেলাক নেটিভ লেডি শেম্ শেম্ শেম্ ॥
*                  *              *
ধন্যরে বোতলবাসি ধন্য লাল জল।
ধন্য ধন্য বিলাতের সভ্যতার ফল॥
*                  *            *
যা থাকে কপালে ভাই টেবিলেতে খাব।
ডুবিয়া ভবের টবে চ্যাপেলেতে যাব॥
কাঁটা ছুরি কাজ নাই কেটে যাবে বাবা।
দুই হাতে পেট ভরে খাব থাবা থাবা॥
পাতরে খাব না ভাত গো টু হেল কাল।
হোটেলে টোটেল নানা সে রকম ভাল॥
পূরিবে সকল আশা ভেব নারে লোভ।
এখনি সাহেব সেজে রাখিব না ক্ষোভ॥
তাঁর
বাঙালির মেয়ে কবিতায়ও অতীতমুখীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। স্ত্রীশিক্ষার প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল না বলে তিনি লিখেছিলেনঃ
লক্ষ্মী মেয়ে যারা ছিল,
তারাই এখন চড়বে ঘোড়া চড়বে ঘোড়া।
ঠাট ঠমকে চালাক চতুর
সভ্য হবে থোড়া থোড়া॥
আর কি এরা এমন কোরে,
সাঁজ সেঁজুতির ব্রত নেবে?
আর কি এরা আদর কোরে,
পিঁড়ি পেতে অন্ন দেবে?
কপালে যা লেখা আছে,
তার ফল তো হবেই হবে।
(এরা) এ বি পোড়ে বিবি সেজে,
বিলিতী বোল কবেই কবে
(এরা) পর্দা তুলে ঘোমটা খুলে,
সেজে গুজে সভায় যাবে।
ড্যাম হিন্দুয়ানী বোলে
বিন্দু বিন্দু ব্রাগিু খাবে॥
আর কিছুদিন থাকলে বেঁচে
সবাই দেখতে পাবেই পাবে
(এরা) আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী,
গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।
জীবনকে হালকাভাবে দেখার একটা বিশেষ দৃষ্টি ঈশ্বর গুপ্তের ছিল বলেই নানা বিষয়ে তিনি রঙ্গরসের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি সমগ্র বিশ্বকে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেছিলেন বলে তাঁর রচনায় সূক্ষ্মতা বা গভীরতা ছিল না। তাই তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়,
ঈশ্বর গুপ্ত সমসাময়িক ঘটনার কবি, লৌকিক আচার ও সামাজিক পরিচিতিরি কবি, গভীর জীবনবোধের কবি নন। এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের মন্তব্যও উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ঈশ্বর গুপ্তের কাব্য চালের কাঁটায়, রান্নাঘরের ধূয়ায়, নাটুরে মাঝির ধ্বজির ঠেলায়, নীলের দাদনে, হোটেলের খানায়, পাঁঠার অস্থিস্থিত মজ্জায়। তিনি আনারসে মধুর রস ছাড়া কাব্যরস পান, তপসে মাছে মৎস্যভাব ছাড়া তপস্বীভাব দেখেন, পাঁঠার বোকা গন্ধ ছাড়া একটু দধীচির গায়ের গন্ধ পান। স্থুল কথা, ঈশ্বর গুপ্ত জবধষরংঃ এবং ঈশ্বর গুপ্ত ঝধঃরৎরংঃ। ইহা তাঁহার সাম্রাজ্য এবং ইহাতে তিনি বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়।
ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন সাংবাদিক। চারদিকে যা দেখেছেন কৌতুক সহকারে তা-ই ফুটিয়ে তুলেছেন। গভীর জীবনবোধের পরিচয় তাঁর কবিতায় নেই। তাঁর প্রতিভা সাংবাদিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যথার্থ শিক্ষার অভাবে তাঁর প্রতিভার উৎকর্ষপূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়নি। সেজন্যই বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন,
আমার বিশ্বাস যে, তিনি যদি তাঁহার সমসাময়িক লেখক কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বা পরবর্তী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ন্যায় সুশিক্ষিত হইতেন, তাহা হইলে তাহার সময়েই বাঙ্গালা সাহিত্য অনেক দূর অগ্রসর হইত। বাঙ্গালার উন্নতি আরও ত্রিশ বৎসর অগ্রসর হইত। তাঁহার রচনায় দুইটি অভাব দেখিয়া বড় দুঃখ হয়- মার্জিত রুচির অভাব এবং উচ্চ লক্ষ্যের অভাব। অনেকটাই ইয়ারকি। আধুনিক সামাজিক বানরদিগের ইয়ারকির মত ইয়ারকি নয়-প্রতিভাশালী মহাত্মার ইয়ারকি। তবু ইয়ারকি বটে।..... ইশ্বর গুপ্তের যে ইয়ারকি, তাহা আমরা ছাড়িতে রাজি নই। বাঙ্গালা সাহিত্যে উহা আছে বলিয়া বাঙ্গালা সাহিত্যে একটা দুর্লভ সামগ্রী আছে। অনেক সময়েই এই ইয়ারকি বিশুদ্ধ এবং ভোগ বিলাসের আকাক্সক্ষা বা পরের প্রতি বিদ্বেষশূন্য রতœটি পাইয়া হারাইতে আমরা রাজি নই, কিন্তু দুঃখ এই যে- এতটা প্রতিভা ইয়ারকিতেই ফুরাইল।
ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় প্রাচীন ও নবীন দুই যুগের বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি যুগের পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে পারেননি বলে প্রাচীন পন্থীর প্রমাণ মিলে। ইংরেজি শিক্ষাসংস্কৃতির প্রতি বিরূপতা তাঁকে এই বৈশিষ্ট্য দান করেছে। কবিওয়ালাদের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন বলে তাঁর কাব্যে সে ধরনের বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশমান। তাঁর রঙ্গব্যঙ্গপ্রবণতা, কৌতুকরসসৃষ্টির দিকে বিশেষ ঝোঁক, অনুপ্রাস যমকের আতিশয্যে চমক লাগানোর প্রয়াস, উচ্চকণ্ঠ হাসিহল্লা- এ সবই কবিওয়ালাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগের প্রমাণ। বাঙালির অন্তঃপুরের বিবিধ ভোজ্যদ্রব্য নিয়ে ঈশ্চর গুপ্ত সে সব কবিতা রচনা করেছেন তাও কবিওয়ালাদের প্রভাবজনিত। তবে তিনি কবিওয়ালাদের অসংলগ্ন ও শিল্পবোধহীন রচনারীতি অতিক্রম করে উন্নত বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তবে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্যও তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। সমাজ সচেতনতা তাঁর কাব্যেই প্রথমবারের মত ফুটে ওঠে। তিনি সমসাময়িক ঘটনা অবলম্বনে অনেক ব্যঙ্গকবিতা রচনা করেছেন
ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার প্রভাবে শিক্ষিত বাঙালি সমাজে যে উচ্ছৃঙ্খলতার প্রকাশ ঘটেছিল তিনি সে সম্পর্কে ব্যঙ্গবিদ্রপাত্মক কবিতা লিখেছেন। সমাজের এই অসংগতি তার কাব্যের উপজীব্য। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম পরিবেশ সচেতন কবি। চারদিকের জীবন তার দৃষ্টিতে কৌতুকের উপাদেয় উপকরণ হিসেব ধরা পড়েছিল। তা নিয়ে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এবং সে ক্ষেত্রে তার মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।  নৈতিকতা, দেশপ্রেম, সমাজসেবা প্রভৃতি বিষয় অবলম্বনেও ঈশ্বর গুপ্ত ব্যঙ্গকবিতা রচনা করেছেন। বস্তুতপক্ষে, সামাজিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে রচিত কবিতাগুলোর মাধ্যমেই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত। পাশ্চাত্য ধ্যানধারণার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। সাংবাদিক হিসেবেও তিনি সমসাময়িক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এদিক থেকে তিনি আধুনিকতার অনুসারী। এদিক থেকে ঈশ্বর গুপ্তকে বাংলা সাহিত্যের জেনাস বলা যায়। গ্রীক দেবতা জেনাস (যার নাম হতে জানুয়ারী মাসের উৎপত্তি) এর দুটি মুখের একটি গত দিনের দিকে অন্যটি অনাগত দিনের দিকে। ইশ্বরগুপ্তও বাংলা সাহিত্য যুগসন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে দুটি যুগকে এক সূত্রে গ্রথিত করে আছেন। তার এক মুখ অতীতে অপর মুখ অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। তাই তার কাব্যে একদিকে পুরাতন অনুকরণ অপর দিকে আধুনিক নতুন ধারার ইঙ্গিতও রয়েছে। 
একদিকে যেমন তিনি সমসাময়িক কবিওয়ালাদের প্রভাবে কবিতা রচনা করেছেন, অন্যদিকে তেমনি ইংরেজি কবিতার আদর্শ অনুসরণে বাংলায় খগু কবিতাও রচনা করেছেন।
ঈশ্বর গুপ্তের রচনায় ইতিহাসচেতনার পরিচয়ও রয়েছে। প্রাচীন কবিদের জীবনী ও কাব্যালোচনার মাধ্যমে তাঁর এই বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটেছে। সমকালীন যুদ্ধবিগ্রহ নিয়েও কবিতা রচনার নিদর্শন তাঁর আছে। সামাজিক কবিতার অর্ন্তগত তাঁর কিছু সংখ্যক দেশপ্রীতিমূলক কবিতাও রয়েছে। এই দিক থেকে তিনি প্রথম আধুনিকতার লক্ষণাক্রান্ত কবি। তবে নতুন ভাবধারায় সম্পূর্ণরূপে অবগাহন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি বলে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়,
ঈশ্বর গুপ্ত আঙ্গিকে পুরানো, কিন্তু ভাবে নতুন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে গদ্য বা পদ্যে ব্যঙ্গবিদ্রুপাত্মক কিছু রচনা করার প্রয়াস প্রায় সকল লেখকের মধ্যেই দেখা যায়। কিন্তু ঈশ্বরগুপ্ত এদিক থেকে এগিয়ে ছিলেন। তাঁর অন্যান্য বিষয়ক কবিতাও রয়েছে। বিশেষত তাঁর নিসর্গ বিষয়ক কবিতার সংখ্যা কম নয়। তবে ব্যঙ্গরসাত্মক কবিতা রচনাকারী হিসেবে ঈশ্বর গুপ্তের বৈশিষ্ট্য সার্থকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসের স্রষ্টা হিসেবে তাঁর বৈশিষ্ট্য অনস্বীকার্য। তাঁর মধ্যে স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবোধেরও পরিচয় মিলে।
তাঁর ব্যঙ্গকবিতার নমুনা হিসেবে কতিপয় পংক্তি উল্লেখ করা হলো।
নীলকর কবিতায় নীলকরদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কবি মহারাণী ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে আবেদন জানিয়েছেন। তাতে নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে তাঁর পরিহাসমধুর মন্তব্য প্রকাশ পেয়েছে ঃ
                               তুমি মা কল্পতরু,        
আমরা সব পোষা গরু
শিখিনি শিং বাঁকানো,
কেবল খাব খোল    বিচালী ঘাস।
যেন রাঙ্গা আমলা,    তুলে মামলা,
গামলা ভাঙ্গে না;
আমরা ভুসি পেলেই খুসি হব,
ঘুসি খেলে বাঁচব না-
তুচ্ছ বিষয় তাঁর কৌতুকরসের প্রেরণা দিয়েছে। তাই
পাঁঠা কবিতায় লিখেছেন ঃ 
রসভরা রসময় রসের ছাগল।
তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল॥
অজস্র প্রশংসাসূচক পংক্তি সাজিয়ে শেষে লিখেছেনঃ
সাধ্য কার এক মুখে মহিমা প্রকাশে।
আপনি করেন বাদ্য আপনার নাশে॥
হাড়িকাষ্ঠে ফেলে দিই ধরে দুই ঠ্যাঙ।
সে সময়ে বাদ্য করে ছ্যাডাঙ ছ্যাডাঙ।
এমন পাঁঠার নাম যে রেখেছে বোকা।
নিজে সেই বোকা নয় ঝাড়বংশে বোকা॥

অনুপ্রাস
বিবিজান চলে যান লবে জান করে।
নির্গুন ঈশ্বর কবিতায়Ñ
তুমি হে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত ত্রি সংসার
আমি হে ঈশ্বর গুপ্ত কুমার তোমার॥
গুপ্ত হোয়ে, গুপ্ত সুতে, ছল কেন কর
গুপ্ত কায়া ব্যক্ত করি গুপ্ত ভার হর॥

বাঙ্গালীর অন্তপুরের বিবিধ ভোজদ্রব্য নিয়ে ঈশ্বর গুপ্ত যে সব কবিতা রচনা করেছেন তা-ও- কবিওয়ালাদের প্রভাবজনিত-
আলু তিন গুড় ক্ষীর নারিকেল আর।
গড়িতেছে-পিঠেপুলি, অশেষ প্রকার॥
বাড়ী বাড়ী নেমন্ত্রন, কুটুম্বের মেলা।
হায় হায় দেশাচার ধন্য তোর খেলা॥


সাবকাশ নাই মাত্র, এলোচুল বাঁধে
ডাল ঝোল মাছ ভাত রাশি রাশি রাধে।
কত তার কাচা থাকে, কত যায় পুড়ে
সাধে রাধে পরমান্ন নলেনের গুড়ে।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঈর্ষা ও আকাক্সক্ষা বিড়ম্বিত গার্হস্থ্য জীবন এবং এর কলহপরায়ণতা, স্থুলরুচি, রন্ধন ও ঢেকিশালার কুশ্রী পরিবেশে অধিষ্ঠিতা বঙ্গ নারীর ব্যঙ্গচিত্র বোধ হয় ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় শেষবারের মত অঙ্কিত হয়েছে।
এই সব ক্ষেত্রে তাঁর কাজে নবযুগের কোন বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। বাংলার এই লৌকিক ও মধ্যযুগীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর কাব্যকে প্রাচীনপন্থী করে রেখেছে।
যে যুগ সংকটকালে ঈশ্বরগুপ্তের আবির্ভাব, তখন বাংলার সমাজে আদর্শভ্রষ্ঠতা ও চারিত্রিক দৈন্য বিশেষভাবে প্রকট। আদর্শবাদী ঈশ্বরগুপ্তের মনে তা প্রবল আলোড়ন ও প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করেছিল।
তাঁর নীতিবিষয়ক কবিতাগুলো সেই প্রতিক্রিয়ার ফল-
সর্ব সাস্ত্রে সুপন্ডিত    কিন্তু একি বিপরীত
ভিতরেতে অভিমান ভরা।
বিদ্যার যে সারমর্ম    নাহি দেখি তার কর্ম
কর্ম্মে  পাই ধর্মের সঞ্চার

ধর্ম কেবল আচার অনুশাসন নয়, ধর্ম সাধনায় যে নৈতিক আধ্যাত্মিক নির্দেশ থাকে, দৈনন্দিন কর্মব্যবস্থার সাথে সেই ধর্ম ব্যবস্থার মিল নেই, নেই যথার্থ ধার্মিকতা। অন্যথায় ধর্ম বন্ধ্যা। ঈশ^র গুপ্ত যে যুগের লোক সে যুগে সাধারণ বাঙালীর কর্ম্মের সাথে ধর্মের যোগ ছিল না। ধর্মের গভীর তত্ত্বে কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। 
কবি তাঁর চারিপাশে যে সব মানুষ দেখেছেন তার মধ্যে প্রকৃত মনুষত্বের প্রকাশ দেখতে না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এমনকি তাঁর মনে মনুষত্বের যে আদর্শ অম্লান ছিল নিজের ব্যবহারে আচরণে কর্মেও সেই মনুষত্বের প্রকাশ তিনি দেখতে পাননি।
স্বরূপ মানুষ কই এমন মানুষ কই
আমি তো মানুষ নিজে নই॥

ঈশ্বরগুপ্তের ধর্মবিষয়ক কবিতাগুলির আলোচনায় দেখা যায় ধর্মের ক্ষেত্রে তিনি যুক্তিবাদী। পূর্বসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের উপর তার আধ্যত্মভক্তির মুল প্রোথিত নয়। যা প্রাচীন, কেবল প্রাচীন বলেই যে তার টিকে থাকার অধিকার আছে ঈশ্বর গুপ্ত সেরূপ অন্ধ গোড়ামিকে প্রশ্রয় দেননি। তাই যেখানে ধর্মের নামে ব্যভিচারকে প্রশ্রয় দেয়া হয় সেখানে তিনি তার স্বমূর্তি প্রকাশ করেছেন।
স্নানযাত্রা কবিতাটিতে এভাবে প্রকাশ আছে। মাহেশের স্নান যাত্রায় হিন্দুদের একটা পবিত্র পর্ব অনুষ্ঠিত হতো, কিন্তু কালক্রমে এই স্নানযাত্রায় পূণ্যার্থীর সংখ্যা হ্রাস পেয়ে প্রমোদার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো এবং এই উপলক্ষে কলিকাতার বহু ধনী নৌকাযোগে নটি বাইজি নিয়ে আমোদ করতে যেতেন। সে যুগের সামাজিক নৈতিক ব্যাভিচারের একটা চমৎকার নিদর্শন পাওয়া যায় এই মাহেশের স্নান যাত্রায়। ঈশ্বরগুপ্ত এর একটি মনোমত বর্ণনা দিয়েছেন-
চরণে বিলাতীজুতো    পরিলেন ধোপ ধুতি
হারিলেন পৈতৃক তসর।
চাপাতলা শূন্যকরি    যান যত নব হরি
ঘস ঘস ঘসর ঘসর॥
ঘাটে গিয়া কত চোট    সুখেতে সাজানো বোট
বাঁধে কোট তাহার ভিতর।
দলে দলে গালাগালি    দলে দলে দলাদলি
বলাবলি হয় পরস্পর।

ভদ্র যত মন শাদা    পরস্পর করি চাঁদা
রুচির তরনীলয় ভাড়া
যাহাতে আসক্তি যার                              সেই শক্তি সংগে তার
গরবেতে গোঁপে দেয় চাড়া।

মাহেশের স্নান যাত্রার মধ্যে এই শ্রেণীর লোকই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কবিতাটির মধ্যে ঐ যুগের ধনীদের নৈতিক চরিত্রের একটি চমৎকার বর্ণনা যেমন পাওয়া যায় তেমনি এর মধ্যে ঈশ্বরগুপ্তের মনের সরলতা ও আধুনিকতার আভাসও পাওয়া যায়। তিনি বলেন,
যায় যায় হিন্দুয়ানী আর নাহি থাকি, তিনিই আবার বলেন, আমি যে অভাগা অতি স্বভাবতই ক্ষীণ মতি কোনো কালে মাহেশে না যাই। এই দুইটিকে মিলিয়ে নিলে উপরিউক্ত মন্তব্যের সত্যাসত্য প্রমাণিত হবে।
স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবোধ ঈশ্বরগুপ্তের আধুনিকতার আর একটি লক্ষণ বলে ধরা যেতে পারে। বাঙালির মধ্যে স্বদেশিকতার স্ফুরণ বোধহয় ইংরেজ প্রভূত্ব স্থাপিত হওয়ার পর দেখা দিয়েছে। এর পূর্বে মাতৃভূমিকে কেন্দ্র করে সুস্পষ্ট কোন ভাবাদর্শ গড়ে উঠেছে বলে মনে হয় না। আঞ্চলিকভাবে কোথাও এর আভাস পাওয়া গেলেও বিদেশী ইংরেজ শক্তির সংগে সংঘর্ষের ফলেই মাতৃভূমির সম্ভ্রম গৌরব সম্পর্কে আমাদের চেতনা জেগেছে, এবং ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় প্রথম ব্যাপকভাবে এর প্রভাব অনুভূত হয়েছে। স্বদেশ কবিতার পংক্তি উল্লেখযোগ্য ঃ

ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে    দেখ দেশবাসী গনে
প্রেম পূর্ণ নয়ন মেলিয়া
কতরূপ স্নেহ করি    দেশের কুকুর ধরি
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া
স্বদেশের প্রেম যত    সেই মাত্র অবগত
বিদেশেতে অধিবাস যার
ভার তুলি ধ্যানে ধরে    চিত্ত পটে চিত্র করে
স্বদেশের সকল ব্যাপার।

যুদ্ধ বিষয়ক কবিতাগুলিতে তিনি ইংরেজের পক্ষ অবলম্বন করেছেন।

রনভূমি ছেড়ে যায় যত চাপ ছেড়ে।
গুলি গোলা অস্ত্র তোপ সবলয় কেড়ে॥
মাথায় পাগড়ী উড়ে পড়ে নদীকূলে।
বুদ্ধি লোপ দাড়ি গোফ সব যায় ঝুলে॥

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবিতায় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করার জন্য ভারতবাসীকে উৎসাহিত করেছেন।
ভারতের অবোধ দুর্বল লোক যত।
ডালভাত মাছ খেয়ে নিদ্রা যাবে কত?
পেটে খেলে পিঠে সয় এই বাক্য ধর।
রাজার সাহায্য হেতু রন সজ্ঞা কর॥
লাহোরের শিখ সেনা শক্ত অতিশয়।
এখন আলস্য করা সমুচিত নয়।

কালগত দিক থেকে আধুনিক যুগের সীমানায় প্রথম কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। কিন্তু তার মধ্যে আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য থাকলেও তিনি মধ্যযুগীয় বৈশিষ্ট্য কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্বন্ধে বলেছেন
সেকাল আর একালের সন্ধিস্থলে ঈশ্বর গুপ্তের আবির্ভাব হাফ আখরাইয়ের দলে তিনি কবিতা বাঁধতেন দেশীভাবে, ছড়া কাটা ব্যঙ্গ প্রবনতা ছিল তাঁর স্বভাব। সাধারণ বাঙালির প্রতিদিনকার জীবন যাত্রার জিনিসে তার অনুরাগ ছিল, আর সেই অভ্যস্ত জীবনকে নতুন কালের দাপাদাপি থেকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপে তিনি রক্ষা করতে চাইতেন। এসব তার একদিক, অন্যদিকে তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্য এমন সভার একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী, নানা রকম সভা সমিতি উৎসবে উৎসাহী এসব নবযুগের প্রাণ ধর্ম। উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলতে পারি। এবং তিনি যে আধুনিক যুগের প্রথম কবি হয়েও একইসংগে প্রাচীন ও আধুনিক উভয় যুগ ধরতে চেয়েছেন তা তাঁর কাব্যের কবিতাগুলির মধ্যেই প্রকাশ পায়।

ব্লগ থেকে সংগৃহীত 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন