আমি...
(THYSELF)
- খন্দকার রাকিব হাসান
১
শরতের সন্ধ্যা। সূর্য অস্ত গিয়েছে অনেক আগেই। তবুও আকাশ এতটাই পরিষ্কার যেন এখনো সূর্যের রক্তিম আভাটা আকাশ কে বিদীর্ণ করে রেখেছে মহাসমারহে। সমান্তরাল দুটি লোহার পাতের উপর দিয়ে সন্ধ্যার চিলের মত ছুটে চলেছে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি।
এই জায়গাটি থেকে ট্রেন চলে যাওয়ার দৃশ্য হয়তো অনেকটাই আলাদা মুখরের কাছে। যেকোনো সন্ধ্যায় সময় পেলেই মুখর এখানে চলে আসে। কখনো একা কখনো তার সাথে আসে প্রতীক। প্রতীক আর মুখরের বয়সের পার্থক্য ৬ বছরের। তবুও ওরা বন্ধু-প্রতিম।
সদ্য জ্বলে ওঠা হলুদ সোডিয়াম বাতিগুলি হাল্কা গোলাপী আর সবুজ রং এর ধোঁয়া তুলে ঝিঁকিয়ে পড়েছে বদ্ধ জলাশয়ের কালচে পানিতে। মুখরের স্তব্ধ দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ। জলাশয়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নিথর লোহা-পাথরের রেল লাইনের উপর দিয়ে সরব উপস্থিতি জানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি। কালচে পানির উপর থেকে ট্রেনের দোদুল্যমান প্রতিবিম্ব ক্রমেই মিলিয়ে গেল।
কালচে পানির উপর ট্রেনের এই দোদুল্যমান প্রতিবিম্বের মাঝে মুখর নিয়তই খুঁজে ফেরে ইট কাঠের এই ঢাকা শহরে তার জীবনের দোদুল্যমানতা।
- জানো প্রতীক আমার খুব ভাল লাগে ঝিকিমিকি আলো-আধারীতে ট্রেনের এই দোদুল্যমান অগ্রসরতা। আমার এই ভাল লাগা টুকুর জন্য টমাস আলভা এডিসন এর বাতি আর মারডক সাহেবের ট্রেনের কাছে আমি আমি খুবই কৃতজ্ঞ। কালচে জলাশয়ের জন্য অবশ্য সিটি মেয়র কে ধন্যবাদ দেয়া যায়। তবে...
- মারডক সাহেব ? ট্রেনের আবিষ্কারক ?
- হ্যাঁ, উইলিয়াম মারডক। স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। তাঁকে ঠিক আবিষ্কারক বলা যায়না, তবে তিনিই প্রথম ট্রেন নির্মাণ করেছিলেন। যদিও সেটা ছিল বাস্পচালিত প্রটোটাইপ মালবাহী ট্রেন । যতদূর সম্ভব ১৭৮৪ সালেই হবে।
- থাক থাক । আপাতত আর লাগবে না। এইবার কি এডিসন সাহেবের বাতির বর্ণিলতা ব্যাখ্যা করবেন নাকি গতির সূত্র ?
- খুব খারাপ লাগে যখন মনে হয় জলাশয়ের পানিতে ট্রেনের এই বর্ণিল অগ্রসরতা শুধুমাত্র ক্রমেই বিলীন হবার জন্যে।
- খারাপই যদি লাগে তাহলে এখানে আসেন কেন?
- কিছু কিছু খারাপ লাগার মধ্যে বিশেষ ধরনের আনন্দ থাকে, যা ঠিক কি ধরনের আনন্দ তার পছন্দসই ব্যাখ্যা দেয়া যায়না।
- যেমন?
- এই যেমন ধরো, ধূমপান করার পর একধরনের খারাপ লাগে, কিন্তু ধুমপানের মধ্যে বিশেষ ধরনের আনন্দ আছে। তবে, কি সেই আনন্দ তার ব্যাখ্যা দুঃসাধ্য।
- নেশা। আপনার এই ভাল লাগতে লাগতে খারাপ লাগাটা বোধ হয় এক ধরনের নেশা।
- হুম নেশা, নেশাই বটে।
২
“রাত এখন দেড়টা । খুব ইচ্ছে করছে গলা ছেড়ে কবিতা আবৃত্তি করি । কিন্তু সমাজ-বিধির পথ এক্ষেত্রে ভিন্ন । নেই আমার এই সঙ্গত মনোবাসনা পূরণের বিন্দুমাত্র অধিকার । সবাই এখন সারাদিনের ক্লান্তি মুছে ফেলতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । ভাবছি, যদি পাখি হতাম; স্বাধীনতার সংজ্ঞাটাকে উল্টে দিয়ে শুরু করতাম রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুনীল কিম্বা অন্য যে কারো সুন্দর কোনো কবিতা – যা আমার হৃদয় কে স্পর্শ করে ।
_ আরে ধ্যাত, কি ভাবছি এসব এই রাত্রি দ্বিপ্রহরে !
পাখি হলে কি আসলেই কবিতা আবৃত্তি করতে পারতাম ? হয়তো পারতাম হয়তোবা পারতাম না । তবে এখন মানুষ হিসেবে গর্ব এইটুকুই যে, অন্তত ইচ্ছেটাকে তো প্রকাশ করতে পারছি !”
অনেকেই আছেন যারা ডাইরী লিখতে পছন্দ করেননা । আবার অনেকে রীতিমত ভয় পান । মুখর তাদের মধ্যে অন্যতম না হলেও একজন। ডাইরীটা গত জন্মদিনে উপহার পেয়েছে । আজ হঠাত চোখে পড়ায় লিখতে বসেছে। একেবারে প্রথমপাতায় । সাঁঝবাতি এর আগে অনেকবারই অভিমান করেছে তার দেয়া ডাইরীতে কিছু না লেখার কারনে। মুখর যথারীতি নির্লিপ্ত ই থেকেছে । মুখরের এই নির্লিপ্ততার কারনে সাঁঝবাতি যেন কোনক্রমেই অভিমান করে থাকতে পারেনা ।
মুখর সাঁঝবাতির নামটাকে ছেঁটে রূপ দিয়েছে সাঁঝি । যদিও এই সংক্ষিপ্ত নামকরণটি মোটেও পছন্দ নয় সাঁঝবাতির । কারন তার নিজের নামটি তার খুবই প্রিয়। তবে মুখর তার কাছে আরো বেশি প্রিয়। মাঝে মাঝেই অনেক আদর মাখা স্বরে সে সাঁঝি বলে ডাকে । তখন অবশ্য সাঁঝি নামটা তার ভালই লাগে। আসলে প্রিয় মানুষের অপ্রিয় কথা গুলিও মাঝে মাঝে কেন জানি মধুর লাগে ।
মুখর দ্বৈতসত্তার অধিকারী। কখনও আবেগপ্রবণ আবার কখনও বাস্তববাদী। ওর ব্যবহার ও চালচলনে কোথায় যেন একটা অদ্ভুত আকর্ষণ রয়েছে । আকর্ষণটা যে ঠিক কোথায় সম্পর্কের ৪ বছরেও তা আবিষ্কার করতে পারেনি সাঁঝি । সে সহজেই রেগে যায় আবার খুব কমসময়ে সবকিছু ভুলে যায় । আবার সব অবস্থাতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে পারাটা অবাক করে সাঁঝিকে । বুদ্ধিবৃত্তিক যে কোনো বিষয়েই প্রবল আকর্ষণ মুখরের । তবে কোনো কিছুরই গভীর থেকে আরো গভীরে যেতে সে মোটেই পছন্দ করে না। আসলে মুখর একসঙ্গে অনেক কিছু করতে চায়, এতে দেখা যায় কোনো কিছুই শেষপর্যন্ত পূর্ণতা পায় না। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা অস্থির মন ওকে তাড়া করে বেড়ায় । কিন্তু হঠাতই সবাইকে চমকে দিয়ে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে ।
ওর চরিত্রের একটা বিষয়ে সাঁঝির প্রচন্ড হিংসা লাগে, সেটা হল অদম্য ইচ্ছেশক্তি । আর তা এতটাই প্রবল যে, যেকোন কিছুই শিখে নিতে পারে সাবলীলভাবে। সব সময়ই পরিবর্তন ও বৈচিত্র্যের প্রত্যাশী। মুখর তার উচ্চাভিলাষী জীবনকে বৈচিত্র্যময় করার জন্য যে কোনো কিছু করতেই আপত্তিহীন । এমনকি চতুরতা ও কূট-কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করতেও দ্বিধা করে না ।
এত কিছুর মধ্যেও মুখরের সঙ্গই সাঁঝির সবচেয়ে ভাললাগা। কেনই বা নয়? একসঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তথ্যবহুল এবং যৌক্তিক সর্বোপরি বাঙময় আলাপ-আলোচনায় মুখরিত করে রাখে সমস্ত সময়টা।
চলবে ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন