শুক্রবার, ৭ জুন, ২০১৩

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতাসংগ্রহ—ভূমিকা জীবনচরিত ও কবিত্ব [১২৯২ সালে প্রকাশিত]

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতাসংগ্রহভূমিকা
জীবনচরিত ও কবিত্ব
[১২৯২ সালে প্রকাশিত]
উপক্রমণিকা
বাঙ্গালা সাহিত্যে আর যাহারই অভাব থাকুককবিতার অভাব নাই। উৎকৃষ্ট কবিতারও অভাব নাইবিদ্যাপতি হইতে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেক সুকবি বাঙ্গালায় জন্ম গ্রহণ করিয়াছেনঅনেক উত্তম কবিতা লিখিয়াছেনবলিতে গেলে বরং বলিতে হয় যেবাঙ্গালা সাহিত্যকাব্যরাশি ভারে কিছু পীড়িত। তবে আবার ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা সংগ্রহ করিয়া সে বোঝা আরও ভারি করি কেনসেই কথাটা আগে বুঝাই।
প্রবাদ আছে যেগরিব বাঙ্গালীর ছেলে সাহেব হইয়ামোচার ঘণ্টে অতিশয় বিস্মিত হইয়াছিলেন। সামগ্রীটা কি এবহুকষ্টে পিসীমা তাঁহাকে সামগ্রী বুঝাইয়া দিলেতিনি স্থির করিলেন যেএ কেলা কা ফুল। রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া যায় যেএখন আমরা সকলেই মোচা ভুলিয়া কেলা কা ফুল বলিতে শিখিয়াছি। তাই আজ ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা সংগ্রহ করিতে বসিয়াছি। আর যেই কেলা কা ফুল বলুকঈশ্বর গুপ্ত মোচা বলেন।
একদিন বর্ষাকালে গঙ্গাতীরস্থ কোন ভবনে বসিয়াছিলাম। প্রদোষকালেপ্রস্ফুটিত চন্দ্রালোকে বিশাল বিস্তীর্ণ ভাগীরথী লক্ষবীচিবিক্ষেপশালিনীমৃদু পবনহিল্লোলে তরঙ্গভঙ্গচঞ্চল চন্দ্রকরমালা লক্ষ তারকার মত ফুটিতেছিল ও নিবিতেছিল। যে বারাণ্ডায় বসিয়াছিলাম তাহার নীচে দিয়া বর্ষার তীব্রগামী বারিরাশি মৃদু রব করিয়া ছুটিতেছিল। আকাশে নক্ষত্রনদীবক্ষে নৌকায় আলোতরঙ্গে চন্দ্ররশ্মি! কাব্যের রাজ্য উপস্থিত হইল। মনে করিলামকবিতা পড়িয়া মনে তৃপ্তি সাধন করি। ইংরেজি কবিতায় তাহা হইল নাইংরেজির সঙ্গে এ ভাগীরথীর ত কিছুই মিলে না। কালিদাস ভবভূতিও অনেক দূরে।
মধুসূদনহেমচন্দ্রনবীনচন্দ্র কাহাতেও তৃপ্তি হইল না। চুপ করিয়া রহিলাম। এমন সময়ে গঙ্গাবক্ষ হইতে মধুর সঙ্গীতধ্বনি শুনা গেল। জেলে জাল বাহিতে বাহিতে গায়িতেছে
সাধো আছে মা মনে।
দুর্গা বলে প্রাণ ত্যজিব,জাহ্নবী-জীবনে।তখন প্রাণ জুড়াইলমনের সুর মিলিলবাঙ্গালা ভাষায়বাঙ্গালীর মনের আশা শুনিতে পাইলামএ জাহ্নবি-জীবন দুর্গা বলিয়া প্রাণ ত্যজিবারই বটেতাহা বুঝিলাম। তখন সেই শোভাময়ী জাহ্নবিসেই সৌন্দর্যময় জগৎসকলই আপনার বলিয়া বোধ হইলএতক্ষণ পরের বলিয়া বোধ হইতেছিল।
সেইরূপআজিকার দিনের অভিনব এবং উন্নিতর পথে সমারূঢ় সৌন্দর্যবিশিষ্ট বাঙ্গালা সাহিত্য দেখিয়া অনেক সময়ে বোধ হয়হৌক সুন্দরকিন্তু এ বুঝি পরেরআমাদের নহে। খাঁটি বাঙ্গালী কথায়খাঁটি বাঙ্গালীর মনের ভাব ত খুঁজিয়া পাই না। তাই ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছি। এখানে সব খাঁটি বাঙ্গালা। মধুসূদনহেমচন্দ্রনবীনচন্দ্ররবীন্দ্রনাথশিক্ষিত বাঙ্গালীর কবি ঈশ্বর গুপ্ত বাঙ্গালীর কবি। এখন আর খাঁটি বাঙ্গালী কবি জন্মে নাজন্মিবার যো নাইজন্মিয়া কাজ নাই। বাঙ্গালার অবস্থা আবার ফিরিয়া অবনতির পথে না গেলে খাঁটি বাঙ্গালী জন্মিতে পারে না। আমরা বৃত্রসংহার” পরিত্যাগ করিয়া পৌষপার্বণ” চাই না। কিন্তু তবু বাঙ্গালীর মনে পৌষপার্বণে যে একটা সুখ আছেবৃত্রসংহারে তাহা নাই। পিঠা পুলিতে যে একটা সুখ আছেশচীর বিম্বাধরপ্রতিবিম্বিত সুধায় তাহা নাই। সে জিনিসটা একেবারে আমাদের ছাড়িলে চলিবে না দেশশুদ্ধ জোনস্গমিসের তৃতীয় সংস্করণে পরিণত হইলে চলিবে না। বাঙ্গালী নাম রাখিতে হইবে। জননী জন্মভূমিকে ভালবাসিতে হইবে। যাহা মার প্রসাদতাহা যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিতে হইবে। এই দেশী জিনিসগুলি মার প্রসাদ। এই খাঁটি বাঙ্গালাটিএই খাঁটি দেশী কথাগুলি মার প্রসাদ। মার প্রসাদে পেট না ভরেবিলাতী বাজার হইতে কিনিয়া খাইতে পারিকিন্তু মার প্রসাদ ছাড়িব না। এই কবিতাগুলি মার প্রসাদ। তাই সংগ্রহ করিলাম।
এই সংগ্রহের জন্য বাবু গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ই পাঠকের ধন্যবাদের পাত্র। তাঁহার উদ্যোগ ও পরিশ্রম ও যত্নেই ইহা সম্পন্ন হইয়াছে। ইহাতে যে পরিশ্রম আবশ্যক তাহা আমাকে করিতে হইলেআমি কখন পারিয়া উঠিতাম না।
এক্ষণে পাঠককে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের যে জীবনী উপহার দিতেছিতাহার জন্যও ধন্যবাদ গোপাল বাবুরই প্রাপ্য। তাঁহার জীবনী সংগ্রহ করিয়া গোপাল বাবু আমাকে কতকগুলি নোট দিয়াছিলেন। আমি সেই নোটগুলি অবলম্বন করিয়া এই জীবনী সঙ্কলন করিয়াছি। গোপাল বাবু নিজে সুলেখকএবং বাঙ্গালা সাহিত্যসংসারে সুপরিচিত। তাঁহার নোটগুলি এরূপ পরিপাটী যেআমি তাহাতে কাটাকুটি বড় করি নাইকেবল আমার নিজের বক্তব্যের সঙ্গে গাঁথিয়া দিয়াছি। প্রথম পরিচ্ছেদটি বিশেষতঃ এই প্রণালীতে লিখিত। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেগোপাল বাবুর নোটগুলি প্রায় বজায় রাখিয়াছিআর কিছুই গাঁথিতে হয় নাই। তৃতীয় পরিচ্ছেদের জন্য আমি একাই সম্পূর্ণরূপে দায়ী।
এই কথাগুলি বলিবার তাৎপর্য এই যেগোপাল বাবুই এই সংগ্রহ ও জীবনী জন্য আমার ও সাধারণের নিকট বিশেষ কৃতজ্ঞতার পাত্র।
প্রথম পরিচ্ছেদবাল্য ও শিক্ষা
প্রয়াগে যুক্তবেণী-বাঙ্গালার ধান্যক্ষেত্র মধ্যে মুক্তবেণী-কলিকাতার ১৫ ক্রোশ উত্তরে গঙ্গাযমুনাসরস্বতী ত্রিপথগামিনী হইয়াছেন। যেখানে এই পবিত্র তীর্থস্থানতাহার পশ্চিম পারস্থ গ্রামের নাম ত্রিবেণী”—পূর্ব পারস্থিত গ্রামের নাম কাঞ্চনপল্লী” বা কাঁচরাপাড়া।
কাঁচরাপাড়ার দক্ষিণে কুমারহট্টকুমারহট্টের দক্ষিণে গৌরীভা বা গরিফা। এই তিন গ্রামে অনেক বৈদ্যের বাস। এই বৈদ্যদিগের মধ্যে অনেকেই বাঙ্গালার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছেন। গরিফার গৌরব রামকমল সেনকেশবচন্দ্র সেনকৃষ্ণবিহারী সেনপ্রতাপচন্দ্র মজুমদার। কুমারহট্টের গৌরব কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ। কাঁচরাপাড়ার একটি অলঙ্কার ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত।*
—————-
এই প্রদেশের বৈদ্যগণ রাজকার্যেও প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছেন। নাম করিলে অনেকের নাম করা যাইতে পারে।
—————-
কাঁচরাপাড়া গ্রামে রামচন্দ্র দাস একটি বৈদ্যবংশের আদি পুরুষ। তাঁহার একমাত্র পুত্রের নাম রামগোবিন্দ। রামগোবিন্দের দুই পুত্র, (১) বিজয়রাম, (২) নিধিরাম। বিজয়রাম পণ্ডিত বলিয়া খ্যাত ছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় তাঁহার বিলক্ষণ অধিকার ছিল। সেই জন্য তিনি বাচস্পতি উপাধি প্রাপ্ত হয়েন। তাঁহার একটি টোল ছিলতথায় অনেক ছাত্র সংস্কৃতসাহিত্যব্যাকরণকাব্যঅলঙ্কার প্রভৃতি তাঁহার নিকট শিক্ষা করিত। তিনি সংস্কৃত ভাষায় কয়েকখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেনকিন্তু তাহা প্রকাশিত হয় নাই।
কনিষ্ঠ নিধিরামআয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রে বিলক্ষণ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। তিনি কবিভূষণ উপাধি পাইয়াছিলেন। নিধিরামের তিনটি পুত্র জন্মে, (১) বৈদ্যনাথ, (২) ভোলানাথ এবং (৩) গোপীনাথ।
গোপীনাথের প্রথম পক্ষের দ্বিতীয় পুত্র হরিনারায়ণ দাসের ঔরসে শ্রীমতী দেবীর গর্ভে (১) গিরিশচন্দ্র, (২) ঈশ্বরচন্দ্র, (৩) রামচন্দ্র (৪) শিবচন্দ্র এবং একটি কন্যা জন্ম গ্রহণ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্রপিতার দ্বিতীয় পুত্র। তিনি ১৭৩৩ শকের (বাঙ্গালা ১২১৮ সালে) ২৫এ ফাল্গুনে শুক্রবারে কাঁচরাপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
গুপ্তেরা তাদৃশ ধনী ছিল না মধ্যবিত্ত গৃহস্থ। পৈতৃক ধান্যক্ষেত্রপুষ্করিণীউদ্যানএবং রাইয়তি জমির আয়ে এই একান্নভুক্ত পরিবারের কোন অভাব ঘটিত না। সমাজ মধ্যে এই গৃহস্থেরা মান্য গণ্য ছিল।
ঈশ্বরচন্দ্রের পিতাচিকিৎসা-ব্যবসায় ত্যাগ করিয়াস্বগ্রামের নিকট শেয়ালডাঙ্গার কুটিতে মাসিক ৮ টাকা বেতনে কাজ করিতেন।
কলিকাতা জোড়াসাঁকোয় ঈশ্বরচন্দ্রের মাতামহাশ্রম। ঈশ্বরচন্দ্র শৈশব হইতেই স্বীয় জননীর সহিত কাঁচরাপাড়াএবং মাতামহাশ্রমে বাস করিতেন। মাতামহ রামমোহন গুপ্ত উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে কানপুরে বিষয়-কর্ম করিতেন। মাতামহের অবস্থা বড় ভাল ছিল না।
ঈশ্বরচন্দ্রের বাল্যকালের যে দুই একটা কথা জানা যায়তাহাতে বোধ হয়ঈশ্বর বড় দুরন্ত ছেলে ছিলেন। সাহসটা খুব ছিল। পাঁচ বৎসর বয়সে কালীপূজার দিনঅমাবস্যার রাত্রেএকা নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছিলেন। অন্ধকারেএকজন কেহ পথে তাঁহার ঘাড়ে পড়িয়া গিয়াছিল। সে ঘোর অন্ধকারে তাঁহাকে চিনিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—
কেরে?—কে যায়?”
আমিঈশ্বর।
একেলা এই অন্ধকারে অমাবস্যার রাত্রিতে কোথায় যাইতেছিস?”
ঠাকুর মশায়ের বাড়ী লুচি আনিতে।দেশকাল গুণে এ সাহসের পরিমাণহোগলকুঁড়িয়ায় বসিয়া কবিতা লেখা!
ঈশ্বরচন্দ্রের বয়ঃক্রম যৎকালে ১০ বর্ষসেই সময়ে তাঁহার মাতার মৃত্যু হয়।
স্ত্রীবিয়োগের কিছুদিন পরেই তাঁহার পিতা হরিনারায়ণ দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন। তিনি বিবাহ করিয়া শ্বশুরালয় হইতে বাটী না আসিয়া কার্যস্থলে গমন করেন। নব বধূ একাকিনী কাঁচরাপাড়ার বাটীতে আসিলেহরিনারায়ণের বিমাতা (মাতা জীবিতা ছিলেন না) তাঁহাকে বরণ করিয়া লইতেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র সেই সময়ে যাহা করিয়াছিলেনতাহা তাঁহার চরিত্রের উপযোগী বটে। ঈশ্বরচন্দ্রের এই মহৎ গুণ ছিল যেতিনি খাঁটি জিনিষ বড় ভালবাসিতেনমেকির বড় শত্রু। এই সংগ্রহস্থিত কবিতাগুলি পড়িলেই পাঠক দেখিতে পাইবেনযে কবি মেকির বড় শত্রু-সকল রকম মেকির উপর তিনি গালি বর্ষণ করিতেছেনগবর্ণর জেনেরল হইতে কলিকাতার মুটে পর্যন্ত কাহারও মাফ নাই। এই বিমাতার আগমনে কবির সঙ্গে মেকির প্রথম সম্মুখ সাক্ষাৎ। খাঁটি মা কোথায় চলিয়া গিয়াছেতাহার স্থানে একটা মেকি মা আসিয়া দাঁড়াইল। মেকির শত্রু ঈশ্বরচন্দ্রের রাগ আর সহ্য হইল নাএক গাছা রুল লইয়া স্বীয় বিমাতাকে লক্ষ্য করিয়া বিষম বেগে তিনি নিক্ষেপ করিলেন। কবিপ্রযুক্ত রুল সৌভাগ্যক্রমেবিমাতার অপেক্ষা আরও অসার সামগ্রী খুঁজিলবিমাতা ত্যাগ করিয়া একটা কলা গাছে বিন্ধিয়া গেল।
অস্ত্র ব্যর্থ দেখিয়া কিরাতপরাজিত ধনঞ্জয়ের মত ঈশ্বরচন্দ্র এক ঘরে ঢুকিয়া সমস্ত দিন দ্বার রুদ্ধ করিয়া রহিলেন। কিন্তু বরদানার্থ পিনাকহস্তে পশুপতি না আসিয়াপ্রহারার্থ জুতাহস্তে জ্যেঠা মহাশয় আসিয়া উপস্থিত। জ্যেঠা মহাশয় দ্বার ভাঙ্গিয়া ঈশ্বরচন্দ্রকে পাদুকা প্রহার করিয়া চলিয়া গেলেন।
কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের পাশুপত অস্ত্র সংগ্রহ হইল সন্দেহ নাই। তিনি বুঝিলেনএ সংসার মেকি চলিবার ঠাঁইমেকির পক্ষ হইয়া না চলিলে এখানে জুতা খাইতে হয়। ইহার পর যখন তাঁহার লেখনী হইতে অজস্র তীর জ্বালাবিশিষ্ট বক্রোক্তি সকল নির্গত হইলতখন পৃথিবীর অনেক রকম মেকি তাঁহার নিকট জুতা খাইল। কবিকে মারিলেকবি মার তুলিয়া রাখেন। ইংরেজ সমাজ বায়রণকে প্রপীড়িত করিয়াছিলবায়রণডন জুয়ানে তাহার শোধ লইলেন।
পরে ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ আসিয়া সান্ত্বনা করিয়া বলেন, “তোদের মা নাইমা হইলতোদেরই ভাল। তোদেরি দেখিবে শুনিবে।আবার মেকি! জ্যেঠা মহাশয় যা হৌকখাঁটি রকম জুতা মারিয়া গিয়াছিলেনকিন্তু পিতামহের নিকট এ স্নেহের মেকি ঈশ্বরচন্দ্রের সহ্য হইল না। ঈশ্বরচন্দ্র পিতামহের মুখের উপর বলিলেন,—
হাঁ! তুমি আর একটা বিয়ে করে যেমন বাবাকে দেখ্‌ছবাবা আমাদের তেমনই দেখ্‌বেন।দুরন্ত ছেলেকাজেই ঈশ্বরচন্দ্র লেখা পড়ায় বড় মন দিলেন না। বুদ্ধির অভাব ছিল না। কথিত আছে ঈশ্বরচন্দ্রের যখন তিন বৎসর বয়সতখন তিনি একবার কলিকাতায় মাতুলালয়ে আসিয়া পীড়িত হয়েন। সেই পীড়ায় তাঁহাকে শয্যাগত হইয়া থাকিতে হয়। কলিকাতা তৎকালে নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর ছিল এবং মশা মাছির বড়ই উপদ্রব ছিল। প্রবাদ আছেঈশ্বরচন্দ্র শয্যাগত থাকিয়া সেই মশা মাছির উপদ্রবে একদা স্বতঃই আবৃত্তি করিতে থাকেন।
রেতে মশা দিনে মাছি,এই তাড়্‌য়ে কল্‌কেতায় আছি।
I lisped in numbers, for the numbers came!
তাই নাকিঅনেকে কথাটা না বিশ্বাস করতে পারেনআমরা বিশ্বাস করিব কি না জানি না। তবে যখন জন ষ্টুয়ার্ট মিলের তিন বৎসর বয়সে গ্রীক শেখার কথাটা সাহিত্যজগতে চলিয়া গিয়াছেতখন এ কথাটা চলুক।
ঈশ্বরচন্দ্রের পূর্বপুরুষদিগের মধ্যে অনেকেইতৎকালে সাধারণ্যে সমাদৃত পাঁচালিকবি প্রভৃতিতে যোগদান এবং সংগীত রচনা করিতে পারিতেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা ও পিতৃব্যদিগের রচনা শক্তি ছিল। বীজ গুণে নাকি অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে।
কিন্তু পাঠশালায় গিয়া লেখা পড়া শিখিতে ঈশ্বরচন্দ্র মনোযোগী ছিলেন না। কখনও পাঠশালায় যাইতেনকখনও বা টো টো করিয়া খেলিয়া বেড়াইতেন। এ সময় মুখে মুখে কবিতা রচনায় তৎপর ছিলেন। পাঠশালার উচ্চশ্রেণীর ছাত্রেরা পারস্য ভাষায় যে সকল পুস্তক অর্থ করিয়া পাঠ করিতশুনিয়াঈশ্বর তাহার এক এক স্থল অবলম্বন পূর্বক বাঙ্গালা ভাষায় কবিতা রচনা করিতেন।
ঈশ্বরচন্দ্রকে লেখা পড়া শিক্ষায় অমনোযোগী দেখিয়াগুরুজনেরা সকলেই বলিতেনঈশ্বর মূর্খ এবং অপরের গলগ্রহ হইবেন। চিরজীবন অন্নবস্ত্রের জন্য কষ্ট পাইবে।
সেই অনাবিষ্ট বালক সমাজে লব্ধপ্রবিষ্ট হইয়াছিলেন। আমাদের দেশে সচরাচর প্রচলিত প্রথানুসারে লেখা পড়া না শিখিলেই ছেলে গেল স্থির করা যায়। কিন্তু ক্লাইব বালককালে কেবল পরের ফলকরা চুরি করিয়া বেড়াইতেনবড় ফ্রেডিক বাপের অবাধ্য বয়াটে ছেলে ছিলেনএবং আর আর অনেকে এইরূপ ছিলেন। কিম্বদন্তী আছেস্বয়ং কালিদাস নাকি বাল্যকালে ঘোর মূর্খ ছিলেন।
মাতৃহীন হইবার পরই ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতায় আসিয়া মাতুলালয়ে অবস্থান করিতে থাকেন। কলিকাতায় আসিয়া সামান্য প্রকার শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। স্বভাবসিদ্ধ কবিতা রচনায় বিশেষ মনোযোগ থাকায়শিক্ষার প্রতি দৃষ্টি দিতেন না।
ঈশ্বরচন্দ্র যে ভ্রমে পতিত হইয়াছিলেনআজ কাল অনেক ছেলেকে সেই ভ্রমে পতিত হইতে দেখি। লিখিবার একটু শক্তি থাকিলেইঅমনি পড়া শুনা ছাড়িয়া দিয়া কেবল রচনায় মন। রাতারাতি যশস্বী হইবার বাসনা। এই সকল ছেলেদের দুই দিক নষ্ট হয়রচনাশক্তি যেটুকু থাকেশিক্ষার অভাবে তাহা সামান্য ফলপ্রদ হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বাল্যে পড়া শুনায় অমনোযোগী হউনশেষে তিনি কিছু শিখিয়াছিলেন। তাঁহার গদ্য রচনায় তাহার বিলক্ষণ প্রমাণ আছে। কিন্তু তিনি বাল্যকালে যে সম্পূর্ণ শিক্ষালাভ করেন নাইইহা বড় দুঃখেরই বিষয়। তিনি সুশিক্ষিত হইলেতাঁহার যে প্রতিভা ছিলতাহার বিহিত প্রয়োগ হইলেতাঁহার কবিত্বকার্যএবং সমাজের উপর আধিপত্য অনেক বেশী হইত। আমার বিশ্বাসযে তিনি যদি তাঁহার সমসাময়িক লেখক কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় বা পরবর্তী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ন্যায় সুশিক্ষিত হইতেনতাহা হইলে তাঁহার সময়েই বাঙ্গালা সাহিত্য অনেক দূর অগ্রসর হইত। বাঙ্গালার উন্নতি আরও ত্রিশ বৎসর অগ্রসর হইত। তাঁহার রচনায় দুইটি অভাব দেখিয়া বড় দুঃখ হয়মার্জিত রুচির অভাবএবং উচ্চ লক্ষ্যের অভাব। অনেকটাই ইয়ারকি। আধুনিক সামাজিক বানরদিগের ইয়ারকির মত ইয়ারকি নয়প্রভাবশালী মহাত্মার ইয়ারকি। তবু ইয়ারকি বটে। জগদীশ্বরের সঙ্গেও একটু ইয়ারকিকহিতে না পার কথাকি রাখিব নাম?তুমি হে আমার বাবা হাবা আত্মারাম।
ঈশ্বর গুপ্তের যে ইয়ারকিতাহা আমরা ছাড়িতে রাজি নই। বাঙ্গালা সাহিত্যে উহা আছে বলিয়াবাঙ্গালা সাহিত্যে একটা দুর্লভ সামগ্রী আছে। অনেক সময়েই এই ইয়ারকি বিশুদ্ধএবং ভোগবিলাসের আকাঙ্ক্ষা বা পরের প্রতি বিদ্বেষশূন্য। রত্নটি হারাইতে আমরা রাজি নইকিন্তু দুঃখ এই যেএতটা প্রতিভা ইয়ারকিতেই ফুরাইল।
একজন দেউলেপড়া শুঁড়ীমতি শীলের গল্প শুনিয়াদুঃখ করিয়া বলিয়াছিল, “কত লোকে খালি বোতল বেচিয়া বড় মানুষ হইলআমি ভরা বোতল বেচিয়া কিছু করিতে পারিলাম না?” সুশিক্ষার অভাবে ঈশ্বর গুপ্তের ঠিক তাই ঘটিয়াছিল। তাই এখনকার ছেলেদের সতর্ক করিতেছিভাল শিক্ষা লাভ না করিয়া কালির আঁচড় পাড়িও না। মহাত্মাদিগের জীবনচরিতের সমালোচনায় অনেক গুরুতর নীতি আমরা শিখিয়া থাকি। ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনের সমালোচনায় আমরা এই মহতী নীতি শিখিসুশিক্ষা ভিন্ন প্রতিভা কখন পূর্ণ ফলপ্রদা হয় না।
ঈশ্বরচন্দ্রের স্মৃতিশক্তি বাল্যকাল হইতে অত্যন্ত প্রখর ছিল। একবার যাহা শুনিতেনতাহা আর ভুলিতেন না। কঠিন সংস্কৃত ভাষার দুর্বোধ্য শ্লোকসমূহের ব্যাখ্যা একবার শুনিয়াই তাহা অবিকল কবিতায় রচনা করিতে পারিতেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁহার একজন বাল্যসখা১২৬৬ সালের ১লা বৈশাখের সংবাদ প্রভাকরে’ নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন
ঈশ্বর বাবু দুগ্ধপোষ্যাবস্থার পরই বিশাল বুদ্ধিশালিতা ব্যক্ত করিতে আরম্ভ করেন। যৎকালীন পাঠশালায় প্রথম শিক্ষায় অতি শৈশবকালে প্রবর্ত হইয়াছিলেনতখন তাঁহা অপেক্ষা অধিকবয়স্ক বালকেরা পারস্য শাস্ত্র পাঠ করিত। তাহাতেই যে দুই একটি পারস্য শব্দ শ্রুত হইততাহার অর্থ শ্রুতি মাত্রেই বিশেষ বিদিত হইয়াবঙ্গ শব্দের সহিত সংযোজনা করিয়াউভয় ভাষায় মিলিত অথচ অর্থবিশিষ্ট কবিতা অনায়াসেই প্রস্তুত করিতেন। ১১। ১২ বৎসর বয়ঃক্রম হইতেই অভ্রমে অত্যল্প পরিশ্রমে ঈদৃশ মনোরম বাঙ্গালা গান প্রস্তুত করিতে পারগ হইয়াছিলেন যেসখের দলের কথা দূরে থাকুকউক্ত কাঞ্চনপল্লীতে বারোইয়ারী প্রভৃতি পূজোপলক্ষে যে সকল ওস্তাদী দল আগমন করিততাহাদের সমভিব্যাহারী ওস্তাদলোক উত্তর গান ত্বরায় প্রস্তুত করিতে অক্ষম হওয়াতে ঈশ্বর বাবু অনায়াসে অতি শীঘ্রই অতি সুশ্রাব্য চমৎকার গান পরিপাটী প্রণালীতে প্রস্তুত করিয়া দিতেন।লেখক পরে লিখিয়া গিয়াছেন, “ঈশ্বর বাবু অপ্রাপ্তব্যবহারাবস্থাতেই ইংরাজি বিদ্যাভ্যাস এবং জীবিকান্বেষণ জন্য কলিকাতায় আগমন করেন। আমার সহিত সন্দর্শন হইয়া প্রথমতঃ যখন তাঁহার সহিত প্রণয় সঞ্চার হয়তখন আমারও পঠদ্দশাতিনি যদিও আমার অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক বয়স্ক ছিলেনতথাপি উভয়েই অপ্রাপ্তবয়স্ককেবল বিদ্যাভ্যাসেই আসক্ত ছিলাম। আমি সে সময় সর্বদা তাঁহার সংসর্গে থাকিতামতাহাতে প্রায় প্রতিদিনই এক একটি অলৌকিক কাণ্ড প্রত্যক্ষ হইত। অর্থাৎ প্রত্যহই নানা বিষয়ে অবলীলাক্রমে অপূর্ব কবিতা রচনা করিয়া সহচর সুহৃৎসমূহের সম্পূর্ণ সন্তোষ বিধান করিতেন। কোন ব্যক্তি কোন কঠিন সমস্যা পূরণ করিতে দিলেতৎক্ষণাৎ তাহা যাদৃশ সাধু শব্দে সম্পূরণ করিতেনতদ্রূপ পূর্বে কদাপি প্রত্যক্ষ হয় নাই।উক্ত বাল্যসখা শেষ লিখিয়া গিয়াছেন, “ঈশ্বর বাবু যৎকালীন ১৭। ‍১৮ বর্ষবয়স্কতৎকালীন দিবা রাত্রি একত্র সহবাস থাকাতে আমার নিকট মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ অধ্যয়ন করিতে আরম্ভ করেন। অনুমান হয়এক মাস কি দেড় মাস মধ্যেই মিশ্র পর্যন্ত এককালীন মুখস্থ ও অর্থের সহিত কণ্ঠস্থ করিয়াছিলেন। শ্রুতিধরদিগের প্রশংসা অনেক শ্রুতিগোচর আছেঈশ্বর বাবুর অদ্ভুত শ্রুতিধরতা সর্বদাই আমার প্রত্যক্ষ হইয়াছে। বাঙ্গালা কবিতা তাঁহার স্বপ্রণীতই হউক বা অন্যকৃতই হউকএকবার রচনা এবং সমক্ষে পাঠ মাত্রই হৃদয়ঙ্গম হইয়াএকেবারে চিত্রপটে চিত্রিতের ন্যায় চিত্রস্থ হইয়া চিরদিন সমান স্মরণ থাকিত।
কলিকাতার প্রসিদ্ধ ঠাকুরবংশের সঙ্গে ঈশ্বর গুপ্তের মাতামহবংশের পরিচয় ছিল। সেই সূত্রে ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতায় আসিয়াই ঠাকুর বাটীতে পরিচিত হয়েন। পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র নন্দকুমার ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের সহিত ঈশ্বরচন্দ্রের বিশেষ সখ্য জন্মে। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁহার নিকট নিয়ত অবস্থানপূর্বক কবিতা রচনা করিয়া সখ্য বৃদ্ধি করিতেন। যোগেন্দ্রমোহনঈশ্বরচন্দ্রের সমবয়স্ক ছিলেন। লেখা পড়া শিক্ষা এবং ভাষানুশীলনে তাহার অনুরাগ ও যত্ন ছিল। ঈশ্বরচন্দ্রের সহবাসে তাঁহার রচনাশক্তিও জন্মিয়াছিল। যোগেন্দ্রমোহনই ঈশ্বরচন্দ্রের ভাবী সৌভাগ্যের এবং যশকীর্তির সোপানস্বরূপ।
ঠাকুর বাটীতে মহেশচন্দ্র নামে ঈশ্বরচন্দ্রের এক আত্মীয়ের গতিবিধি ছিল। মহেশচন্দ্রও কবিতা রচনা করিতে পারিতেন। মহেশের কিঞ্চিৎ বাতিকের ছিট থাকায় লোকে তাঁহাকে মহেশ পাগলা” বলিত। এই মহেশের সহিত ঠাকুর বাটীতে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রায়ই মুখে মুখে কবিতা-যুদ্ধ হইত।
ঈশ্বরচন্দ্রের যৎকালে ১৫ বর্ষ বয়সতৎকালে গুপ্তীপাড়ার গৌরহরি মল্লিকের কন্যা দুর্গামণি দেবীর সহিত তাঁহার বিবাহ হয়।
দুর্গামণির কপালে সুখ হইল না। ঈশ্বরচন্দ্র দেখিলেনআবার মেকি! দুর্গামণি দেখিতে কুৎসিতা! হাবা! বোবার মত! এ ত স্ত্রী নহেপ্রতিভাশালী কবির অর্ধাঙ্গ নহেকবির সহধর্মিণী নহে। ঈশ্বরচন্দ্র বিবাহের পর হইতে আর তাহার সঙ্গে কথা কহিলেন না।
ইহার ভিতর একটু Romanceও আছে। শুনা যায়ঈশ্বরচন্দ্র কাঁচরাপাড়ার একজন ধনবানের একটি পরমা সুন্দরী কন্যাকে বিবাহ করিতে অভিলাষী হয়েন। কিন্তু তাঁহার পিতা সে বিষয়ে মনোযোগী না হইয়াগুপ্তীপাড়ার উক্ত গৌরহরি মল্লিকের উক্ত কন্যার সহিত বিবাহ দেন। গৌরহরিবৈদ্যদিগের মধ্যে একজন প্রধান কুলীন ছিলেনসেই কুল-গৌরবের কারণ এবং অর্থদান করিতে হইল না বলিয়াসেই পাত্রীর সহিতই ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা পুত্রের বিবাহ দেন। ঈশ্বরচন্দ্র পিতার আজ্ঞায় নিতান্ত অনিচ্ছায় বিবাহ করেনকিন্তু বিবাহের পরই তিনি বলিয়াছিলেন যেআমি আর সংসারধর্ম করিব না। কিছু কাল পরে ঈশ্বরচন্দ্রের আত্মীয় মিত্রগণ তাঁহাকে আর একটি বিবাহ করিতে অনুরোধ করিলেতিনি বলেন যেদুই সতীনের ঝগড়ার মধ্যে পড়িয়া মারা যাওয়া অপেক্ষা বিবাহ না করাই ভাল।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনী হইতে আমরা এই আর একটি মহতী নীতি শিক্ষা করি। ভরসা করি আধুনিক বর কন্যাদিগের ধনলোলুপ পিতৃমাতৃগণ এ কথাটা হৃদয়ঙ্গম করিবেন।
ঈশ্বর গুপ্তস্ত্রীর সঙ্গে আলাপ না করুনচিরকাল তাঁহাকে গৃহে রাখিয়া ভরণ-পোষণ করিয়ামৃত্যুকালে তাঁহার ভরণ-পোষণ জন্য কিছু কাগজ রাখিয়া গিয়াছিলেন। দুর্গামণিও সচ্চরিত্রা ছিলেন। কয়েক বৎসর হইলদুর্গামণি দেহ ত্যাগ করিয়াছেন।
এখন আমরা দুর্গামণির জন্য বেশী দুঃখ করিবনা ঈশ্বরচন্দ্রের জন্য বেশী দুঃখ করিবদুর্গামণির দুঃখ ছিল কি না তাহা জানি না। যে আগুনে ভিতর হইতে শরীর পুড়েসে আগুন তাঁহার হৃদয়ে ছিল কি না জানি না। ঈশ্বরচন্দ্রের ছিলকবিতায় দেখিতে পাই। অনেক দাহ করিয়াছে দেখিতে পাই। যে শিক্ষাটুকু স্ত্রীলোকের নিকট পাইতে হয়তাহা তাঁহার হয় না। স্ত্রীলোক তাঁহার কাছে কেবল ব্যাঙ্গের পাত্র। ঈশ্বর গুপ্ত তাহাদের দিগে আঙ্গুল দেখাইয়া হাসেনমুখ ভেঙ্গানগালি পাড়েনতাহারা যে পৃথিবীর পাপের আকর তাহা নানা প্রকার অশ্লীলতার সহিত বলিয়া দেনতাহাদের সুখময়ীরসময়ীপুণ্যময়ী করিতে পারেন না। এক একবার স্ত্রীলোককে উচ্চ আসনে বসাইয়া কবি যাত্রার সাধ মিটাইতে যানকিন্তু সাধ মিটে না। তাঁহার উচ্চাসনস্থিতা নায়িকা বানরীতে পরিণত হয়। তাঁহার প্রণীত মানভঞ্জন” নামক বিখ্যাত কাব্যের নায়িকা ঐরূপ। উক্ত কবিতা আমরা এই সংগ্রহে উদ্ধৃত করি নাই। স্ত্রীলোক সম্বন্ধীয় কথা বড় অল্পই উদ্ধৃত করিয়াছি। অনেক সময়ে ঈশ্বর গুপ্ত স্ত্রীলোক সম্বন্ধে প্রাচীন ঋষিদিগের ন্যায় মুক্তকণ্ঠঅতি কদর্য ভাষার ব্যবহার না করিলেগালি পুরা হইল মনে করেন না। কাজেই উদ্ধৃত করিতে পারি নাই।
এখন দুর্গামণির জন্য দুঃখ করিব নাঈশ্বর গুপ্তের জন্যভরসা করিপাঠক বলিবেনঈশ্বর গুপ্তের জন্য।
১২৩৭ সালের কার্তিক মাসে ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা হরিনারায়ণের মৃত্যু হয়।
মাতার মৃত্যুর পরই ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতায় আসিয়ামাতুলালয়ে থাকিয়াঠাকুর বাটীতেই প্রতিপালিত হইতেন। পিতার মৃত্যুর পর অর্থোপার্জন আবশ্যক হইয়া উঠে। জ্যেষ্ঠ গিরিশচন্দ্র এবং সর্বকনিষ্ঠ শিবচন্দ্র পূর্বেই মরিয়াছিলেন। রামচন্দ্রের লালন পালন ভার ঈশ্বরচন্দ্রের উপরই অর্পিত হয়।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদকর্ম
প্রবাদ আছেলক্ষ্মী সরস্বতীতে চিরকাল বিবাদ। সরস্বতীর বরপুত্রেরা প্রায় লক্ষ্মীছাড়া বরপুত্রেরা সরস্বতীর বিষনয়নে পতিত। কথাটা কতক সত্য হইলেও হইতে পারেকিন্তু সে বিষয়ে লক্ষ্মীর বড় অপরাধ নাই। বিক্রমাদিত্য হইতে কৃষ্ণচন্দ্র পর্যন্ত দেখিতে পাই লক্ষ্মীর বরপুত্রেরা সরস্বতীর পুত্রগণের বিশেষ সহায়। লক্ষ্মীচিরকাল সরস্বতীকে হাত ধরিয়া তুলিয়া খাড়া করিয়া রাখিতেন নহিলে বোধ হয়সরস্বতী অনেক দিনবিষ্ণুপার্শ্বে অনন্ত-শয্যায় শয়ন করিয়াঘোর নিদ্রায় নিমগ্ন হইতেনতাঁহার পালিত গর্দভগুলি সহস্র চীৎকার করিলেও উঠিতেন না। এখন হয়ত সে ভাবটা তেমন নাই। এখন সরস্বতী কতকটা আপনার বলে বলবতী অনেক সময়েই আপনার বলেই পদ্মবনে দাঁড়াইয়া বীণায় ঝঙ্কার দিতেছেন দেখিতে পাই। হয়ত দেখিতে পাইদুই জনে একাসনে বসিয়াই সুখ স্বচ্ছন্দে কাল যাপন করিতেছেনসতীনের মত কোন্দল ঝকড়া নাক কাটাকাটি কিছু নাই অনেক সময়ে দেখি সরস্বতী আসিয়াছেন দেখিয়াই লক্ষ্মী আসিয়া উপস্থিত হন। কিন্তু যখন ঈশ্বর গুপ্ত সরস্বতীর আরাধনায় প্রথম প্রবৃত্ততখন সে দিন উপস্থিত হয় নাই। লক্ষ্মীর একজন বরপুত্র তাঁহার সহায় হইলেন। লক্ষ্মী সরস্বতীকে হাত ধরিয়া তুলিলেন।
যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরঈশ্বরচন্দ্রের কবিত্বশক্তি এবং রচনাশক্তি দর্শনে এই সময়ে অর্থাৎ ১২৩৭ সালে বাঙ্গালা ভাষায় একখানি সংবাদপত্র প্রচার করিতে অভিলাষী হয়েন। ইহার পূর্বে ৬ খানি মাত্র বাঙ্গালা সংবাদপত্র প্রকাশ হইয়াছিল।
(
১) বাঙ্গালা গেজেট”—১২২২ সালে গঙ্গাধর ভট্টাচার্য কর্তৃক প্রকাশ হয়। ইহাই প্রথম বাঙ্গালা সংবাদপত্র। (২) সমাচার দর্পণ”—১২২৪ সালে শ্রীরামপুরের মিশনরিদিগের দ্বারা প্রকাশ হয়। (৩) ১২২৭ সালে রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে—“সংবাদ-কৌমুদী” প্রকাশ হয়। (৪) ১২২৮ সালে সমাচার চন্দ্রিকা”, (৫) সংবাদ তিমিরনাশক” এবং (৬) বাবু নীলরত্ন হালদার কর্তৃক বঙ্গদূত” প্রকাশ হয়।
ঈশ্বরচন্দ্রযোগেন্দ্রমোহনের সাহায্যে উৎসাহে এবং উদ্যোগে সাহসী হইয়াসন ১২৩৭ সালের ১৬ই মাঘে সংবাদ প্রভাকর” প্রচারারাম্ভ করেন। তৎকালে প্রভাকর সপ্তাহে একবার মাত্র প্রকাশ হইত।
ঈশ্বরচন্দ্র ১২৫৩ সালের ১লা বৈশাখের প্রভাকরে প্রভাকরের জন্ম-বিবরণ সম্বন্ধে লিখিয়া গিয়াছেন, “বাবু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের সম্পূর্ণ সাহায্যক্রমে প্রথমে এই প্রভাকর পত্র প্রকটিত হয়। তখন আমাদিগের যন্ত্রালয় ছিল না। চোরাবাগানে এক মুদ্রাযন্ত্র ভাড়া করিয়া ছাপা হইত। ৩৮ সালের শ্রাবণ মাসে পূর্বোক্ত ঠাকুর বাবুদিগের বাটীতে স্বাধীনরূপে যন্ত্রালয় স্থাপিত করা যায়। তাহাতে ৩৯ সাল পর্যন্ত সেই স্বাধীন যন্ত্রে অতি সম্ভ্রমের সহিত মুদ্রিত হইয়াছিল।
কিঞ্চিদধিক ১৯ বর্ষবয়স্ক নবকবি-সম্পাদিত নব প্রভাকর অল্প দিনের মধ্যে সম্ভ্রান্ত কৃতবিদ্যা সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে সমর্থ হয়। কলিকাতার যে সকল সম্ভ্রান্ত ধনবান এবং কৃতবিদ্য লেখকসাপ্তাহিক প্রভাকরের সহায়তা করেনঈশ্বরচন্দ্র ১২৫৩ সালের ১লা বৈশাখের প্রভাকরে তাঁহাদিগের নামের নিম্নলিখিত তালিকা প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন,—
শ্রীযুক্ত রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর৺বাবু নন্দলাল ঠাকুর৺বাবু চন্দ্রকুমার ঠাকুর৺বাবু নন্দকুমার ঠাকুর৺বাবু রামকমল সেনশ্রীযুক্ত বাবু হরকুমার ঠাকুরবাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর৺হলিরাম টেঁকিয়াল ফুক্কনশ্রীযুক্ত জয়গোপাল তর্কালঙ্কারশ্রীযুক্ত প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশবাবু নীলরত্ন হালদারবাবু ব্রজমোহন সিংহ৺কৃষ্ণচন্দ্র বসুবাবু রসিকচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়বাবু ধর্মদাস পালিতবাবু শ্যামাচরণ সেনশ্রীযুক্ত নীলমণি মতিলাল ও অন্যান্য। শ্রীযুক্ত প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ যিনি এক্ষণে সংস্কৃত কলেজের অলঙ্কারশাস্ত্রের অধ্যাপকতিনি লিপি বিষয়ে বিস্তর সাহায্য করিতেন। তাঁহার রচিত সংস্কৃত শ্লোকদ্বয়* অদ্যাবধি প্রভাকরের শিরোভূষণ রহিয়াছে। জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয় অনেক উত্তম উত্তম গদ্য পদ্য লিখিয়া প্রভাকরের শোভা ও প্রশংসা বৃদ্ধি করিয়াছিলেন।এই প্রভাকর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অদ্বিতীয় কীর্তি। মধ্যে একবার প্রভাকর মেঘে ঢাকা পড়িয়াছিলেন বটেকিন্তু আবার পুনরুদিত হইয়া অদ্যাপি কর বিতরণ করিতেছেন। বাঙ্গালা সাহিত্য এই প্রভাকরের নিকট বিশেষ ঋণী। মহাজন মরিয়া গেলে খাতক আর বড় তার নাম করে না। ঈশ্বর গুপ্ত গিয়াছেনআমরা আর সে ঋণের কথা বড় একটা মুখে আনি না। কিন্তু এক দিন প্রভাকর বাঙ্গালা সাহিত্যের হর্তা কর্তা বিধাতা ছিলেন। প্রভাকর বাঙ্গালা রচনার রীতিও অনেক পরিবর্তন করিয়া যান। ভারতচন্দ্রী ধরণটা তাঁহার অনেক ছিল বটেঅনেক স্থলে তিনি ভারতচন্দ্রের অনুগামী মাত্রকিন্তু আর একটা ধরণ ছিলযা কখন বাঙ্গালা ভাষায় ছিল নাযাহা পাইয়া আজ বাঙ্গালার ভাষা তেজস্বিনী হইয়াছে। নিত্য নৈমিত্তিকের ব্যাপাররাজকীয় ঘটনাসামাজিক ঘটনাএ সকল যে রসময়ী রচনার বিষয় হইতে পারেইহা প্রভাকরই প্রথম দেখায়। আজ শিখের যুদ্ধকাল পৌষপার্বণ আজ মিশনরিকাল উমিদারিএ সকল যে সাহিত্যের অধীনসাহিত্যের সামগ্রীতাহা প্রভাকরই দেখাইয়াছিলেন। আর ঈশ্বর গুপ্তের নিজের কীর্তি ছাড়া প্রভাকরের শিক্ষানবিশদিগের একটা কীর্তি আছে। দেশের অনেকগুলি লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক প্রভাকরের শিক্ষনবিশ ছিলেন। বাবু রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় একজন। বাবু দীনবন্ধু মিত্র আর একজন। শুনিয়াছিবাবু মনোমোহন বসু আর একজন। ইহার জন্যও বাঙ্গালার সাহিত্যপ্রভাকরের নিকট ঋণী। আমি নিজে প্রভাকরের নিকটে বিশেষ ঋণী। আমার প্রথম রচনাগুলি প্রভাকরে প্রকাশিত হয়। সে সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আমাকে বিশেষ উৎসাহ দান করেন।
————-
সতাং মনস্তামরসপ্রভাকরঃ সদৈব সর্বেষু সমপ্রভাকরঃ।
উদেতি ভাস্বৎ সকলাপ্রভাকরঃ সদর্থসম্বাদনবপ্রভাকরঃ ||নক্তং চন্দ্রকরেণ ভিন্নমুকুলেষ্বিন্দীবরেষু ক্কচিম্ভ্রামংভ্রামমতান্দ্রমীষদমৃতং পীত্বা ক্ষুধাকাতরাঃ।
অদ্যোদ্যদ্বিমল প্রভাকরকরপ্রোদ্ভিন্নপদ্মোদরে স্বচ্ছন্দং দিবসে পিবন্তু চতুরাঃ স্বান্তদ্বিরেফা রসং ||
————–
১২৩৯ সালে যোগেন্দ্রমোহন প্রাণত্যাগ করায়সংবাদ প্রভাকরের তিরোধান হয়। ঈশ্বরচন্দ্র ১২৫৩ সালের ১লা বৈশাখের প্রভাকরে লিখিয়া গিয়াছেন, “এই সময়ে (১২৩৯ সালে) জগদীশ্বর আমাদিগের কর্ম এবং উৎসাহের শিরে বিষম বজ্র নিক্ষেপ করিলেনঅর্থাৎ মহোপকারী সাহায্যকারী বহুগুণধারী আশ্রয়দাতা বাবু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুর মহাশয় সাংঘাতিক রোগ কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া কৃতান্তের দন্তে পতিত হইলেন। সুতরাং ঐ মহাত্মার লোকান্তরগমনে আমরা অপর্যাপ্ত শোকসাগরে নিমগ্ন হইয়া এককালীন সাহস এবং অনুরাগশূন্য হইলাম। তাহাতে প্রভাকর করের অনাদররূপ মেঘাচ্ছন্ন হওন জন্য এই প্রভাকর কর প্রচ্ছন্ন করিয়া কিছু দিন গুপ্তভাবে গুপ্ত হইলেন।প্রভাকর সম্পাদন দ্বারা ঈশ্বরচন্দ্র সাধারণ্যে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁহার কবিত্ব এবং রচনা শক্তি দর্শনে আন্দুলের জমীদার বাবু জগন্নাথপ্রসাদ মল্লিক১২৩৯ সালের ১০ শ্রাবণে সংবাদ রত্নাবলী” প্রকাশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র সেই পত্রের সম্পাদক হয়েন।
১২৫৯ সালের ১লা বৈশাখের প্রভাকরে ঈশ্বরচন্দ্র সংবাদপত্রসমূহের যে ইতিবৃত্ত প্রকাশ করেনতন্মধ্যে এই রত্নাবলী সম্বন্ধে লিখিয়া গিয়াছেন, “বাবু জগন্নাথপ্রসাদ মল্লিক মহাশয়ের আনুকূল্যে মেছুয়াবাজারের অন্তঃপাতী বাঁশতলার গলিতে সংবাদ রত্নাবলী” আবির্ভূত হইল। মহেশচন্দ্র পাল এই পত্রের নামধারী সম্পাদক ছিলেন। তাঁহার কিছু মাত্র রচনাশক্তি ছিল না। প্রথমে ইহার লিপিকার্য আমরাই নিষ্পন্ন করিতাম। রত্নাবলী সাধারণ সমীপে সাতিশয় সমাদৃত হইয়াছিল। আমরা তৎকর্মে বিবৃত হইলেরঙ্গপুর ভূম্যধিকারী সভার পূর্বতন রাজনারায়ণ ভট্টাচার্য সেই পদে নিযুক্ত হয়েন।ঈশ্বরচন্দ্রের অনুজ রামচন্দ্র১২৬৬ সালের ১লা বৈশাখের প্রভাকরে লিখিয়া গিয়াছেন, “ফলতঃ গুণাকর প্রভাকর কর বহুকাল রত্নাবলীর সম্পাদকীয় কার্যে নিযুক্ত ছিলেন নাতাহা পরিত্যাগ করিয়া দক্ষিণ প্রদেশে শ্রীক্ষেত্রাদি তীর্থ দর্শনে গমন করিয়াকটকে পরম পূজনীয় শ্রীযুক্ত শ্যামামোহন রায় পিতৃব্য মহাশয়ের সদনে কিছু দিন অবস্থান করিয়াএকজন অতি সুপণ্ডিত দণ্ডীর নিকট তন্ত্রাদি অধ্যয়ন করেন। এবং তাহার কিয়দংশ বঙ্গভাষায় সুমিষ্ট কবিতায় অনুবাদও করিয়াছিলেন।
১২৪৩ সালের বৈশাখ মাসে ঈশ্বরচন্দ্র কটক হইতে কলিকাতায় প্রত্যাগমন করেন। তিনি কলিকাতায় আসিয়াই প্রভাকরের পুনঃ প্রচার জন্য চেষ্টিত হয়েন। তাঁহার সে বাসনাও সফল হয়। ১২৫৩ সালের ১লা বৈশাখের প্রভাকরে ঈশ্বরচন্দ্রপ্রভাকরে পূর্ববৃত্তান্ত প্রকাশ সূত্রে লিখিয়া গিয়াছেন, “১২৪৩ সালের ২৭এ শ্রাবণ বুধবার দিবসে এই প্রভাকরকে পুনর্বার বারত্রয়িক রূপে প্রকাশ করিতখন এই গুরুতর কর্ম সম্পাদন করিতে পারিআমাদিগের এমত সম্ভাবনা ছিল না। জগদীশ্বরকে চিন্তা করিয়া এতৎ অসমসাহসিক কর্মে প্রবৃত্ত হইলেপাতুরেঘাটানিবাসী সাধারণ-মঙ্গলাভিলাষী বাবু কানাইলাল ঠাকুরএবং তদনুজ বাবু গোপাললাল ঠাকুর মহাশয় যথার্থ হিতকারী বন্ধুর স্বভাবে ব্যয়োপযুক্ত বহুল বিত্ত প্রদান করিলেনএবং অদ্যাবিধি আমাদিগের আবশ্যক ক্রমে প্রার্থনা করিলে তাঁহারা সাধ্যমত উপকার করিতে ত্রুটি করেন না। এ কারণ আমরা উল্লিখিত ভ্রাতাদ্বয়ের পরোপকারিতা গুণের ঋণের নিমিত্ত জীবনের স্থায়িত্ব কাল পর্যন্ত দেহকে বন্ধক রাখিলাম।অল্পকালের মধ্যেই প্রভাকরের প্রভা আবার সমুজ্জ্বল হইয়া উঠে। নগর এবং গ্রাম্যপ্রদেশের সম্ভ্রান্ত জমীদার এবং কৃত্যবিদ্যগণ এই সময়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে যথেষ্ট সহায়তা করিতে থাকেন। কয়েক বর্ষের মধ্যেই প্রভাকর এত দূর লাভ করে যেঈশ্বরচন্দ্র ১২৪৬ সালের ১লা আষাঢ় হইতে প্রভাকরকে প্রাত্যহিক পত্রে পরিণত করেন। ভারতবর্ষের দেশীয় সংবাদপত্রের মধ্যে এই প্রভাকরই প্রথম প্রাত্যহিক।
প্রভাকর প্রাত্যহিক হইলেযে সকল ব্যক্তি লিপি সাহায্য এবং উৎসাহ দান করেনঈশ্বরচন্দ্র ১২৫৪ সালের ২রা বৈশাখের প্রভাকরে তাঁহাদিগের সম্বন্ধে লিখিয়া গিয়াছেন
প্রভাকরের লেখকের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি হইয়াছেপ্রভাকরের পুরাতন লেখকদিগের মধ্যে যে যে মহোদয় জীবিত আছেনতাঁহাদের নাম নিম্নভাগে প্রকাশ করিলাম:শ্রীযুক্ত প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশরাধানাথ শিরোমণিগৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশবাবু নীলরত্ন হালদারগঙ্গাধর তর্কবাগীশব্রজমোহন সিংহগোপালকৃষ্ণ মিত্র বিশ্বম্ভর পাইনগোবিন্দচন্দ্র সেনধর্মদাস পালিতবাবু কানাইলাল ঠাকুরঅক্ষয়কুমার দত্তনবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় উমেশচন্দ্র দত্তশ্রীশম্ভুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়প্রসন্নচন্দ্র ঘোষরায় রামলোচন ঘোষ বাহাদুরহরিমোহন সেনজগন্নাথপ্রসাদ মল্লিক।
সীতানাথ ঘোষগণেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়যাদবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়হরনাথ মিত্রপূর্ণচন্দ্র ঘোষগোপালচন্দ্র দত্তশ্যামাচরণ বসুউমানাথ চট্টোপাধ্যায়শ্রীনাথ শীলএবং শম্ভুনাথ পণ্ডিত ইঁহারা কেহ তিন চারি বৎসর পর্যন্ত প্রভাকরের লেখক বন্ধুর শ্রেণী মধ্যে ভুক্ত হইয়াছেন।
শ্রীযুক্ত হরচন্দ্র ন্যায়রত্ন ভট্টাচার্য মহাশয়আমাদিগের সম্প্রদায়ের এক জন প্রধান সংযুক্ত বন্ধু শ্যামাচরণ বন্দোপাধ্যায় সহকারী সম্পাদকের ন্যায় তাবৎ কর্ম সম্পন্ন করেনঅতএব ইঁহাদিগের বিষয় প্রকাশ করা অতিরেক মাত্র। বিশেষতঃ শেষোক্ত ব্যক্তির শ্রমের হস্তে যখন আমরা সমুদায় কর্ম সমর্পণ করিতখন তাঁহার ক্ষমতা সকলেই বিবেচনা করিবেন।
রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় অস্মদ্দিগের সংযোজিত লেখক বন্ধুইঁহার সদ্‌গুণ ও ক্ষমতার কথা কি ব্যাখ্যা করিব! এই সময়ে আমাদিগের পরম স্নেহান্বিত মৃত বন্ধু বাবু প্রসন্নচন্দ্র ঘোষের শোক পুনঃ পুনঃ শেল স্বরূপ হইয়া হৃদয় বিদীর্ণ করিতেছে। যেহেতু ইনি রচনা বিষয়ে তাঁহার ন্যায় ক্ষমতা দর্শাইতেছেনবরং কবিত্ব ব্যাপারে ইঁহার অধিক শক্তি দৃষ্ট হইতেছে। কবিতা নর্তকীর ন্যায় অভিপ্রায়ের বাদ্য তালে ইঁহার মানসরূপ নাট্যশালায় নিয়ত নৃত্য করিতেছে। ইনি কি গদ্য কি পদ্য উভয় রচনা দ্বারা পাঠকবর্গের মনে আনন্দ বিতরণ করিয়া থাকেন।
ঠাকুরবংশীয় মহাশয়দিগের নামোল্লেখ করা বাহুল্য মাত্রযেহেতু প্রভাকরের উন্নতি সৌভাগ্য প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি যে কিছু তাহা কেবল ঐ ঠাকুরবংশের অনুগ্রহ দ্বারাই হইয়াছে। মৃত বাবু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রথমতঃ ইহাকে স্থাপিত করেন। পরে বাবু কানাইলাল ঠাকুর ও গোপাললাল ঠাকুর৺চন্দ্রকুমার ঠাকুর৺নন্দলাল ঠাকুরবাবু হরকুমার ঠাকুরবাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুরমৃত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুরবাবু রমানাথ ঠাকুরবাবু মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়বাবু মথুরানাথ ঠাকুরবাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি মহাশয়েরা আমাদিগের আশার অতীত কৃপা বিতরণ করিয়াছেনএবং ইঁহাদিগের যত্নে অদ্যাপি অনেক মহাশয় আমাদিগের প্রতি যথোচিত স্নেহ করিয়া থাকেন।
এই প্রভাকরের প্রতি বাবু গিরিশচন্দ্র দেব মহাশয়ের অত্যন্ত অনুগ্রহ জন্য আমরা অত্যন্ত বাধ্য আছি। বিবিধ বিদ্যাতৎপর মহানুভব বাবু কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় মহাশয় প্রভাকরের প্রতি অতিশয় স্নেহ করতঃ ইহার সৌভাগ্যবর্ধন বিষয়ে বিপুল চেষ্টা করিয়া থাকেন। বাবু রমাপ্রসাদ রায়বাবু কাশীপ্রসাদ ঘোষবাবু মাধবচন্দ্র সেনবাবু রাজেন্দ্র দত্তবাবু হরচন্দ্র লাহিড়ীবাবু অন্নদাপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়রায় বৈকুণ্ঠনাথ চৌধুরীরায় হরিনারায়ণ ঘোষ প্রভৃতি মহাশয়েরা আমাদিগের পত্রে সমাদর করিয়াউন্নতিপ্রকল্পে বিলক্ষণ যত্নশীল আছেন।
প্রভাকরের বর্ষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লেখক এবং সাহায্যকারী সংখ্যা বৃদ্ধি হইতে থাকে। বঙ্গদেশের প্রায় সমস্ত সম্ভ্রান্ত জমীদার এবং কলিকাতার প্রায় সমস্ত ধনবান এবং কৃতবিদ্য ব্যক্তি প্রভাকরের গ্রাহক ছিলেন। মূল্যদানে অসমর্থ অনেক ব্যক্তিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিনামূল্যে প্রভাকর দান করিতেন। তাহার সংখ্যাও ৩।৪ শত হইবে। উত্তর পশ্চিমাঞ্চল প্রভৃতি স্থানের প্রবাসী বাঙ্গালীগণও গ্রাহকশ্রেণীভুক্ত হইয়া নিয়ত স্থানীয় প্রয়োজনীয় সংবাদ পাঠাইতেন। সিপাহী-বিদ্রোহের সময়ে সেই সকল সংবাদদাতা সংবাদ প্রেরণে প্রভাকারের বিশেষ উপকার করেন। প্রভাকর এই সময়ে বাঙ্গালার সংবাদপত্রসমূহের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়া লয়।
১২৫৩ সালে ঈশ্বরচন্দ্র পাষণ্ডপীড়ন” নামে একখানি পত্রের সৃষ্টি করেন। ১২৫৯ সালের ১লা বৈশাখের প্রভাকরে সংবাদপত্রের ইতিবৃত্ত মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র লিখিয়া গিয়াছেন, “১২৫৩ সালের আষাঢ় মাসের সপ্তম দিবসে প্রভাকর যন্ত্রে পাষণ্ডপীড়নের জন্ম হইল। ইহাতে পূর্বে কেবল সর্বজন-মনোরঞ্জন প্রকৃষ্ট প্রবন্ধপুঞ্জ প্রকটিত হইতপরে ৫৪ সালে কোন বিশেষ হেতুতে পাষণ্ডপীড়নপাষণ্ডপীড়ন করিয়াআপনিই পাষণ্ড হস্তে পীড়িত হইলেন। অর্থাৎ সীতানাথ ঘোষ নামক জনৈক কৃতঘ্ন ব্যক্তি যাহার নামে এই পত্র প্রচারিত হয়সেই অধার্মিক ঘোষ বিপক্ষের সহিত যোগদান করতঃ ঐ সালের ভাদ্র মাসে পাষণ্ডপীড়নের হেড চুরি করিয়া পলায়ন করিলসুতরাং আমাদিগের বন্ধুগণ তৎপ্রকাশে বঞ্চিত হইলেন। ঐ ঘোষ উক্ত পত্র ভাস্করের করে দিয়া পাতরে আছড়াইয়া নষ্ট করিল।সংবাদ ভাস্কর-সম্পাদক গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের সহিত ঈশ্বরচন্দ্রের অনেক দিন হইতেই মিত্রতা ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র ১২৫৩ সালের ২রা বৈশাখের প্রভাকরে লিখিয়া গিয়াছেন, “সুবিখ্যাত পণ্ডিত ভাস্কর-সম্পাদক তর্কবাগীশ মহাশয় পূর্বে বন্ধুরূপে এই প্রভাকরের অনেক সাহায্য করিতেনএক্ষণে সময়াভাবে আর সেরূপ পারেন না।১২৫৪ সালের ১লা বৈশাখের প্রভাকরে ঈশ্বরচন্দ্র পুনরায় লেখেন, “ভাস্কর-সম্পাদক ভট্টাচার্য মহাশয় এইক্ষণে যে গুরুতর কার্য সম্পাদন করিতেছেনতাহাতে কি প্রকারে লিপি দ্বারা অস্মৎ পত্রের আনুকূল্য করিতে পারেনতিনি ভাস্কর পত্রকে অতি প্রশংসিত রূপে নিষ্পন্ন করিয়া বন্ধুগণের সহিত আলাপাদি করেনইহাতেই তাহাকে যথেষ্ট ধন্যবাদ প্রদান করি। বিশেষতঃ সুখের বিষয় এই যেসম্পাদকের যে যথার্থ ধর্মতাহা তাঁহাতেই আছে।এই ১২৫৪ সালেই তর্কবাগীশের সহিত ঈশ্বরচন্দ্রের বিবাদ আরম্ভ এবং ক্রমে প্রবল হয়। ঈশ্বরচন্দ্র পাষণ্ডপীড়ন” এবং তর্কবাগীশ রসরাজ” পত্র অবলম্বনে কবিতা-যুদ্ধ আরম্ভ করেন। শেষে নিতান্ত অশ্লীলতাগ্লানিএবং কুৎসাপূর্ণ কবিতায় পরস্পরে পরস্পরকে আক্রমণ করিতে থাকেন। দেশের সর্বসাধারণে সেই লড়াই দেখিবার জন্য মত্ত হইয়া উঠে। সেই লড়াইয়ে ঈশ্বরচন্দ্রেরই জয় হয়।
কিন্তু দেশের রুচিকে বলিহারি! সেই কবিতা-যুদ্ধ যে কি ভয়ানক ব্যাপারতাহা এখনকার পাঠকের বুঝিয়া উঠিবার সম্ভাবনা নাই। দৈবাধীন আমি এক সংখ্যা মাত্র রসরাজ একদিন দেখিয়াছিলাম। চারি পাঁচ ছত্রের বেশী আর পড়া গেল না। মনুষ্যভাষা যে এত কদর্য হইতে পারেইহা অনেকেই জানে না। দেশের লোকে এই কবিতা-যুদ্ধে মুগ্ধ হইয়াছিলেন। বলিহারি রুচি! আমার স্মরণ হইতেছেদুই পত্রের অশ্লীলতায় জ্বালাতন হইয়ালং সাহেব অশ্লীলতা নিবারণ জন্য আইন প্রচারে যত্নবান ও কৃতকার্য হয়েন। সেই দিন হইতে অশ্লীলতা পাপ আর বড় বাঙ্গালা সাহিত্যে দেখা যায় না।
অনেকের ধারণা যেএই বিবাদ সূত্রে উভয়ের মধ্যে বিষম শত্রুতা ছিল। সেটি ভ্রম। তর্কবাগীশ গুরুতর পীড়ায় শয্যাগত হইলেঈশ্বরচন্দ্র তাঁহাকে দেখিতে গিয়া বিশেষ আত্মীয়তা প্রকাশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র যে সময়ে মৃত্যুশয্যায় পতিত হনতর্কবাগীশও সে সময়ে রুগ্নশয্যায় পতিত ছিলেনসুতরাং সে সময়ে তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখিতে আসিতে পারেন নাই। ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পর তর্কবাগীশ সেই রুগ্নশয্যায় শয়ন করিয়া ভাস্করে যাহা লিখিয়াছিলেননিম্নে তাহা দেওয়া গেল,—
প্রশ্ন। প্রভাকর-সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কোথায়?উত্তর। স্বর্গে?প্র। কবে গেলেন?উ। গত শনিবার গঙ্গাযাত্রা করিয়াছিলেনরাত্রি দুই প্রহর এক ঘণ্টাকালে গমন করিয়াছেন।
প্র। তাঁহার গঙ্গাযাত্রা ও মৃত্যুশোকের বিষয়শনিবাসরীয় ভাস্করে প্রকাশ হয় নাই কেন?উ। কে লিখিবেগৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য শয্যাগত।
প্র। কত দিন?উ। এক মাস কুড়ি দিন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য এই দুইটি নাম দক্ষিণ হস্তে লইয়া বক্ষঃস্থলে রাখিয়া দিয়াছেনযদি মৃত্যুমুখ হইতে রক্ষা পানতবে আপনার পীড়ার বিষয় ও প্রভাকর-সম্পাদকের মৃত্যুশোক স্বহস্তে লিখিবেনআর যদি প্রভাকর-সম্পাদকের অনুগমন করিতে হয়তবে উভয় সম্পাদকের জীবন বিবরণ ও মৃত্যুশোক প্রকাশ জগতে অপ্রকাশ রহিল।তর্কবাগীশ মহাশয়ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর ঠিক এক পক্ষ পরেই অর্থাৎ ১২৬৫ সালের ২৪এ মাঘ প্রাণত্যাগ করেন।
পাষণ্ডপীড়ন উঠিয়া যাইলে১২৫৪ সালের ভাদ্র মাসে ঈশ্বরচন্দ্র সাধুরঞ্জন” নামে আর একখানি সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশ করেন। এখানিতে তাঁহার ছাত্রমণ্ডলীর কবিতা ও প্রবন্ধ সকল প্রকাশ হইত। সাধুরঞ্জন” ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পর কয়েক বর্ষ পর্যন্ত প্রকাশ হইয়াছিল।
অল্প বয়স হইতেই ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতা এবং মফস্বলের অনেকগুলি সভায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তত্ত্ববোধিনী সভাটাকীর নীতিতরঙ্গিণী সভাদর্জিপাড়ার নীতিসভা প্রভৃতির সভ্যপদে নিযুক্ত থাকিয়া মধ্যে মধ্যে বক্তৃতাপ্রবন্ধ এবং কবিতা পাঠ করিতেন। তাঁহার সৌভাগ্যক্রমে তিনি আজিকার দিনে বাঁচিয়া নাই তাহা হইলে সভার জ্বালায় ব্যতিব্যস্ত হইতেন। রামরঙ্গিণীশ্যামতরঙ্গিণীনববাহিনীভবদাহিনী প্রভৃতি সভার জ্বালায়তিনি কলিকাতা ছাড়িতেন সন্দেহ নাই। কলিকাতা ছাড়িলেও নিষ্কৃতি পাইতেনএমন নহে। গ্রামে গেলে দেখিতেনগ্রামে গ্রামরক্ষিণী সভাহাটে হাটভঞ্জিনীমাঠে মাঠসঞ্চারিণীঘাটে ঘাটসাধনীজলে জলতরঙ্গিণীস্থলে স্থলশায়িনীখানায় নিখাতিনীডোবায় নিমজ্জিনীবিলে বিলবাসিনীএবং মাচার নীচে অলাবুসমাহারিণী সভা সকল সভ্য সংগ্রহের জন্য আকুল হইয়া বেড়াইতেছে।
সে কাল আর এ কালের সন্ধিস্থানে ঈশ্বর গুপ্তের প্রাদুর্ভাব। এ কালের মত তিনি নানা সভার সভ্যনানা স্কুল কমিটির মেম্বার ইত্যাদি ছিলেনআবার ও দিকে কবির দলেহাফ আখড়াইয়ের দলে গান বাঁধিতেন। নগর এবং উপনগরের সখের কবি এবং হাফ আখড়াই দল-সমূহের সংগীতসংগ্রামের সময় তিনি কোন না কোন পক্ষে নিযুক্ত হইয়া সংগীত রচনা করিয়া দিতেন। অনেক স্থলেই তাঁহার রচিত গীত ঠিক উত্তর হওয়ায় তাঁহারই জয় হইত। সখের দলসমূহ সর্বাগ্রে তাঁহাকেই হস্তগত করিতে চেষ্টা করিততাঁহাকে পাইলে আর অন্য কবির আশ্রয় লইত না।
সন ১২৫৭ সাল হইতে ঈশ্বরচন্দ্র একটি নূতন অনুষ্ঠান করেন। নববর্ষে অর্থাৎ প্রতি বর্ষের ১লা বৈশাখে তিনি স্বীয় যন্ত্রালয়ে একটি মহতী সভা সমাহূত করিতে আরম্ভ করেন। সেই সভায় নগরউপনগরএবং মফস্বলের প্রায় সমস্ত সম্ভ্রান্ত লোক এবং সে সময়ের সমস্ত বিদ্বান ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ আমন্ত্রিত হইয়া উপস্থিত হইতেন। কলিকাতার ঠাকুরবংশমল্লিকবংশদত্তবংশশোভাবাজারের দেববংশ প্রভৃতি সমস্ত সম্ভ্রান্ত বংশের লোকেরা সেই সভায় উপস্থিত হইতেন। বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতির ন্যায় মান্যগণ্য ব্যক্তিগণ সভাপতির আসন গ্রহণ করিতেন। ঈশ্বরচন্দ্র সেই সভায় মনোরম প্রবন্ধ এবং কবিতা পাঠ করিয়াসভাস্থ সকলকে তুষ্ট করিতেন। পরে ঈশ্বরচন্দ্রের ছাত্রগণের মধ্যে যাঁহাদিগের রচনা উৎকৃষ্ট হইততাঁহারা তাহা পাঠ করিতেন। যে সেকল ছাত্রের রচনা উৎকৃষ্ট হইততাঁহারা নগদ অর্থ পুরস্কার স্বরূপ পাইতেন। নগর ও মফস্বলের অনেক সম্ভ্রান্তলোক ছাত্রদিগকে সেই পুরস্কার দান করিতেন। সভাভঙ্গের পর ঈশ্বরচন্দ্র সেই আমন্ত্রিত প্রায় চারি পাঁচ শত লোককে মহাভোজ দিতেন।
প্রাত্যহিক প্রভাকরের কলেবর ক্ষুদ্রএবং তাহাতে সম্পাদকীয় উক্তি এবং সংবাদাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রদান করিতে হইতএজন্য ঈশ্বরচন্দ্র তাহাতে মনের সাধে কবিতা লিখিতে পারিতেন না। সেইজন্যই তিনি ১২৬০ সালের ১লা তারিখ হইতে এক একখানি স্থূলকায় প্রভাকর প্রতি মাসের ১লা তারিখে প্রকাশ করিতেন। মাসিক প্রভাকরে নানাবিধ খণ্ড কবিতা ব্যতীত গদ্যপদ্যপূর্ণ গ্রন্থও প্রকাশ করিতে থাকেন।
প্রভাকরের দ্বিতীয় বার অভ্যুদয়ের কয়েক বর্ষ পর হইতেই ঈশ্বরচন্দ্র দৈনিক প্রভাকর সম্পাদনে ক্ষান্ত হয়েন। কেবল মধ্যে মধ্যে কবিতা লিখিতেন এবং বিশেষ রাজনৈতিক বা সামাজিক কোন ঘটনা হইলেতৎসম্বন্ধে সম্পাদকীয় উক্তি লিখিতেন। সহকারী সম্পাদক বাবু শ্যামাচরণ বন্দোপাধ্যায় সমস্ত কার্য সম্পাদন করিতেন। মাসিক পত্র সৃষ্টির পর হইতে ঈশ্বরচন্দ্র বিশেষ পরিশ্রম করিয়াতাহা সম্পাদন করিতেন। শেষ অবস্থায় ঈশ্বরচন্দ্রের দেশপর্যটনে বিশেষ অনুরাগ জন্মে। সেই জন্যই তিনি সহকারীর হস্তে সম্পাদনভার দান করিয়াপর্যটনে বহির্গত হইতেন। কলিকাতায় থাকিলেঅধিকাংশ সময়ে উপনগরের কোন উদ্যানে বাস করিতেন।
শারদীয়া পূজার পর জলপথে প্রায়ই ভ্রমণে বহির্গত হইতেন। তিনি পূর্ববাঙ্গালা ভ্রমণে বহির্গত হইয়ারাজা রাজবল্লভের কীর্তিনাশ দর্শনে কবিতা প্রণয়নপূর্বক প্রভাকরে প্রকাশ করেন। আদিশূরের যজ্ঞস্থলের ইতিবৃত্তও প্রকাশ করিয়াছিলেন। গৌড় দর্শন করিয়া তাহার ধ্বংসাবশেষ সম্বন্ধে কবিতা রচনা করেন। গয়াবারানসীপ্রয়াগ প্রভৃতি প্রদেশ ভ্রমণে বর্ষাধিক কাল অতিবাহিত করেন। তিনি যেখানে যাইতেনসেইখানেই সমাদর এবং সম্মানের সহিত গৃহীত হইতেন। যাঁহারা তাঁহাকে চিনিতেন নাতাঁহারাও তাঁহার মিষ্টভাষিতায় মুগ্ধ হইয়া আদর করিতেন। এই ভ্রমণসূত্রে স্বদেশেরসকল প্রান্তের সম্ভ্রান্ত লোকের সহিতই তাঁহার আলাপ পরিচয় এবং মিত্রতা হইয়াছিল। তাঁহাকে প্রাপ্ত হইয়ামফস্বলের ধনবান জমীদারগণ মহানন্দ প্রকাশ করিতেন এবং অযাচিত হইয়া পাথেয়স্বরূপ পর্যাপ্ত অর্থ এবং নানাবিধ মূল্যবান দ্রব্য উপহার দিতেন। যাঁহার সহিত একবার আলাপ হইততিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের মিত্রতা-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইতেন। মিষ্টভাষিতা এবং সরলতা দ্বারা তিনি সকলেরই হৃদয় হরণ করিতেন। ভ্রমণকালে কোন অপরিচিত স্থানে নৌকা লাগিলেতীরে উঠিয়া পথে যে সকল বালককে খেলিতে দেখিতেনতাহাদিগের সহিত আলাপ করিয়াতাহাদিগের বাটীতে যাইতেন। তাহাদিগের বাটীতে লাউকুমড়া প্রভৃতি কোন ফল মূল দেখিতে পাইলে চাহিয়া আনিতেন। ইহাতে কোন হীনতা বোধ করিতেন না। বালকদিগের অভিভাবকগণ শেষে ঈশ্বরচন্দ্রের পরিচয় প্রাপ্ত হইলেযথাসাধ্য সমাদর করিতে ত্রুটি করিতেন না। ভ্রমণকালে বালকদিগকে দেখিতে পাইলেতাহাদিগকে ডাকিয়া গান শুনিতেন এবং সকলকে পয়সা দিয়া তুষ্ট করিতেন।
প্রাচীন কবিদিগের অপ্রকাশিত লুপ্তপ্রায় কবিতাবলীগীতপদাবলী এবং তৎসহ তাঁহাদিগের জীবনী প্রকাশ করিতে অভিলাষী হইয়া ঈশ্বরচন্দ্র ক্রমাগত দশবর্ষকাল নানা স্থান পর্যটনএবং যথেষ্ট শ্রম করিয়াশেষ সে বিষয়ে সফলতা লাভ করেন। বাঙ্গালীজাতির মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রই এ বিষয়ের প্রথম উদ্যোগী। সর্বাদৌ ১২৬০ সালের ১লা পৌষের মাসিক প্রভাকরে ঈশ্বরচন্দ্র বহুকষ্টে সংগৃহীত রামপ্রসাদ সেনের জীবনী ও তৎপ্রণীত কালীকীর্তন” ও কৃষ্ণকীর্তন” প্রভৃতি বিষয়ক অনেকগুলি লুপ্তপ্রায় গীত এবং পদাবলী প্রকাশ করেন। তৎপরে পর্যায়ক্রমে প্রতি মাসের প্রভাকরে রামনিধি সেন (নিধুবাবু)হরঠাকুররাম বসুনিতাইদাস বৈরাগীলক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাসরাসু ও নৃসিংহ এবং আরও কয়েক জন প্রাচীন খ্যাতনামা কবির জীবনচরিতগীত এবং পদাবলী প্রকাশ করেন। সেগুলি স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে প্রকাশ করিবার বিশেষ ইচ্ছা ছিলকিন্তু প্রকাশ করিয়া যাইতে পারেন নাই।
মৃত কবি ভারতচন্দ্র রায়ের জীবনী এবং তৎপ্রণীত অনেক লুপ্তপ্রায় কবিতা এবং পদাবলী বহুপরিশ্রমে সংগ্রহ করিয়াসন ১২৬২ সালের ১লা জ্যৈষ্ঠের প্রভাকরে প্রকাশ করেন। সেই সণের আষাঢ় মাসে তাহা স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন।ইহাই ঈশ্বরচন্দ্রের প্রথম পুস্তক।
১২৬৪ সালের ১লা বৈশাখের প্রভাকরে প্রবোধ প্রভাকর” নামে গ্রন্থ প্রকাশারম্ভ হইয়াসেই সনের ১লা ভাদ্রে তাহা শেষ হয়। পদ্মলোচন ন্যায়রত্ন সেই পুস্তক প্রণয়ন কালে তাঁহার বিশেষ সহায়তা করেন। উক্ত সনের ১লা চৈত্রে প্রবোধ প্রভাকর” স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে প্রকাশ হয়।
তৎপরে প্রতি মাসের মাসিক প্রভাকরে ক্রমান্বয়ে হিতপ্রভাকর” এবং বোধেন্দুবিকাশ” প্রকাশ ও সমাপ্ত করেন। ঈশ্বরচন্দ্র নিজে তাহা স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে প্রকাশ করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার অনুজ বাবু রামচন্দ্র গুপ্ত পরে পুস্তকাকারে হিতপ্রভাকর” ও বোধেন্দুবিকাশের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। তিনখানি পুস্তকেরই দ্বিতীয় খণ্ড অপ্রকাশিত আছে।
কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপন্যাস এবং নীতিবিষয়ক অনেকগুলি কবিতা নীতিহার” নামে প্রভাকরে প্রকাশ করেন।
১২৬৫ সালের মাঘ মাসের মাসিক প্রভাকর সম্পাদনের পর ঈশ্বরচন্দ্র শ্রীমদ্ভাগবতের বাঙ্গালা কবিতায় অনুবাদ আরম্ভ করিয়াছিলেন। মঙ্গলাচরণ এবং পরবর্তী কয়েকটি শ্লোকের অনুবাদ করিয়াই তিনি মৃত্যুশয্যায় শয়ন করেন।
অবিশ্রান্ত মস্তিষ্ক চালনাসূত্রে মধ্যে মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রের স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইত। সেই জন্যই মধ্যে মধ্যে জলপথে এবং স্থলপথে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেন। ১২৬০ সাল হইতে ঈশ্বরচন্দ্রের শ্রম বৃদ্ধি হয়। মাসিক পত্র সম্পাদন এবং উপর্যুপরি কয়খানি গ্রন্থ এই সময় হইতে লিখেন। কিন্তু এই সময়টিই তাঁহার জীবনের মধ্যাহ্নকালস্বরূপ সমুজ্জ্বল।
১২৬৫ সালের মাঘের মাসিক প্রভাকর সম্পাদন করিয়াই ঈশ্বরচন্দ্র জ্বররোগে আক্রান্ত হয়েন। শেষ তাহা বিকারে পরিণত হয়। উক্ত সনের ৮ই মাঘের প্রভাকরের সম্পাদকীয় উক্তিতে নিম্নলিখিত কথা প্রকাশ হয়;—
অদ্য কয়েক দিবস হইতে আমাদিগের সর্বাধ্যক্ষ কবিকুলকেশরী শ্রীযুক্ত বাবু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহাশয় জ্বরবিকার রোগাক্রান্ত হইয়া শয্যাগত আছেন। শারীরিক গ্লানি যথেষ্ট হইয়াছিলসদুপযুক্ত গুণযুক্ত এতদ্দেশীয় বিখ্যাত ডাক্তার শ্রীযুক্ত বাবু গোবিন্দচন্দ্র গুপ্তশ্রীযুক্ত বাবু দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায় প্রভৃতি মহোদয়েরা চিকিৎসা করিতেন। তদ্দ্বারা শারীরিক গ্লানি অনেক নিবৃত্তি পাইয়াছে। ফলে এক্ষণে রোগ নিঃশেষ হয় নাই।ঈশ্বরচন্দ্রের রোগের সংবাদ প্রকাশ হইবামাত্র দেশের সকলেই উদ্বিগ্ন হইয়া উঠেন। কলিকাতার সম্ভ্রান্ত লোকেরা এবং মিত্রমণ্ডলী দুঃখিতান্তকরণে ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখিতে যান। অনেকে বহুক্ষণ পর্যন্ত ঈশ্বরচন্দ্রের নিকট অবস্থানতত্ত্বাবধান এবং চিকিৎসা বিষয়ে পরামর্শ দান করিতে থাকেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের পীড়ায় সাধারণকে নিতান্ত উদ্বিগ্ন এবং বিশেষ বিবরণ জানিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিতে দেখিয়াপরদিনের অর্থাৎ ৯ই মাঘের প্রভাকরে তাঁহার অবস্থার ও চিকিৎসার বিবরণ প্রকাশিত হয়।
তৎপরদিন অর্থাৎ ১০ই মাঘের প্রভাকরে তাহার পর বৃত্তান্ত লিখিত হয়। পীড়ায় সকল মনুষ্যেরই দুঃখ সমানসকল চিকিৎসকেরই বিদ্যা সমান এবং সকল ব্যাধিরই পরিণাম শেষ এক। অতএব সে সকল কিছুই উদ্ধৃত করিবার প্রয়োজন দেখি না।
১০ই মাঘ শনিবারে ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনাশা ক্ষীণ হইয়া আসিলেহিন্দুপ্রথামত তাঁহাকে গঙ্গাযাত্রা করান হয়। ১২ই মাঘ সোমবারের প্রভাকরে ঈশ্বরচন্দ্রের অনুজ রামচন্দ্র লেখেন,—
সংবাদ প্রভাকরের জন্মদাতা ও সম্পাদক আমার সহোদর পরমপূজ্যবর ৺ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহোদয় গত ১০ই মাঘ শনিবার রজনী অনুমান দুই প্রহর এক ঘটিকা কালে ৺ভাগীরথীতীরে নীরে সজ্ঞানে অনবরত স্বীয়াভিষ্টদেব ভগবানের নাম উচ্চারণ পূর্বক এতন্মায়াময় কলেবর পরিত্যাগ পূর্বক পরলোকে পরমেশ্বর সাক্ষাৎকার গমন করিয়াছেন।এক্ষণে ঈশ্বরচন্দ্রের চরিত্র সম্বন্ধে দুই একটা কথা বলিয়া এই পরিচ্ছেদ শেষ করিব। ঈশ্বরচন্দ্রের ভাগ্য তাঁহার স্বহস্তগঠিত।
তিনি কলিকাতায় আগমন করিয়াঅনুজ রামচন্দ্রের সহিত পরান্নে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। একদা সেই সময়ে রামচন্দ্রকে বলিয়াছিলেন, “ভাইআমাদিগের মাসিক ৪০‍্ টাকা আয় হইেলউত্তমরূপে চলিবে।” শেষ প্রভাকরের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের দৈন্যদশা বিদূরিত হইয়াসম্ভ্রান্ত ধনবানের ন্যায় আয় হইতে থাকে। প্রভাকর হইতেই অনেক টাকা আসিত। তদ্ব্যতীত সাধারণের নিকট হইতে সকল সময়েই বৃত্তি প্রভৃতি প্রাপ্ত হইতেন। একদা অনুজ রামচন্দ্রকে অর্থোপার্জনে উদাসীন দেখিয়া বলিয়াছিলেন, “আমি এক দিন ভিক্ষা করিতে বাহির হইলেএই কলিকাতা হইতেই লক্ষ টাকা ভিক্ষা করিয়া আনিতে পারিতোর দশা কি হইবে?” বাস্তবিক ঈশ্বরচন্দ্রের সেইরূপ প্রতিপত্তি হইয়াছিল।
অর্থের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের কিছুমাত্র মমতা ছিল না। পাত্রাপাত্র ভেদ জ্ঞান না করিয়া সাহায্যপ্রার্থী মাত্রকেই দান করিতেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ প্রতিনিয়তই তাঁহার নিকট যাতায়াত করিতেনঈশ্বরচন্দ্রও তাঁহাদিগকে নিয়মিত বার্ষিক বৃত্তি দান ব্যতীত সময়ে সময়ে অর্থসাহায্য করিতেন। পরিচিত বা সামান্য পরিচিত ব্যক্তিঋণ প্রার্থনা করিলেতদ্দণ্ডেই তাহা প্রদান করিতেন। কেহ সে ঋণ পরিশোধ না করিলেতাহা আদায় জন্য ঈশ্বরচন্দ্র চেষ্টা করিতেন না। এই সূত্রে তাঁহার অনেক অর্থ পরহস্তগত হয়। সমধিক আয় হইতে থাকিলেও তাহার রীতিমত কোন হিসাবপত্র ছিল না। ব্যয় করিয়া যে সময়ে যত টাকা বাঁচিততাহা কলিকাতার কোন না কোন ধনী লোকের নিকট রাখিয়া দিতেন। তাহার রসিদপত্র লইতেন না। তাঁহার মৃত্যুর পর অনেক বড়লোক (!!) সেই টাকাগুলি আত্মসাৎ করেন। রসিদ অভাবে তদীয় ভ্রাতা তৎসমস্ত আদায় করিতে পারেন নাই।
ঈশ্বরচন্দ্রের বাটীর দ্বার অবারিত ছিল। দুই বেলাই ক্রমাগত উনুন জ্বলিতযে আসিতসেই আহার পাইত। তিনি প্রায় মধ্যে মধ্যে ভোজের অনুষ্ঠান করিয়াআত্মীয় মিত্র এবং ধনী লোকদিগের আহার করাইতেন।
ঈশ্বরচন্দ্র প্রতি বৎসর বাঙ্গালার অনেক সম্ভ্রান্ত লোকের নিকট হইতে মূল্যবান শাল উপহার পাইতেন। তৎসমস্ত গাঁটরি বাঁধা থাকিত। একদা একজন পরিচিত লোক বলিলেন, “শাল গুলা ব্যবহার করেন নাপোকায় কাটিবেনষ্ট হইয়া যাইবে কেন বিক্রয় করিলেঅনেক টাকা পাওয়া যাইবে। আমাকে দিউনবিক্রয় করিয়া টাকা আনিয়া দিব।” ঈশ্বরচন্দ্র তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া কয়েক শত টাকা মূল্যের এক গাঁটরি শাল তাহাকে দিলেন। কিন্তু সে ব্যক্তি আর টাকাও দেয় নাইশাল ও ফিরাইয়া দেয় নাইঈশ্বরচন্দ্রও তাহার আর কোন তত্ত্বও লয়েন নাই।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাল্যকালে যদিও উদ্ধতঅবাধ্য এবং স্বেচ্ছানুরক্ত ছিলেনবয়োবৃদ্ধি-সহকারে সে সকল দোষ যায়। তিনি সদাই হাস্যবদন মিষ্ট কথারসের কথাহাসির কথা নিয়তই মুখে লাগিয়া থাকিত। রহস্য এবং ব্যঙ্গ তাঁহার প্রিয় সহচর ছিল। কপটতাছলনাচাতুরী জানিতেন না। তিনি সদালাপী ছিলেন। কথায় হউকবক্তৃতায় হউকবিবাদে হউককবিতায় হউকগীতে হউকলোককে হাসাইতে বিলক্ষণ পটু ছিলেন। সামান্য বালক হইতে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলের সহিত সমান ব্যবহার করিতেন। শত্রুরাও তাঁহার ব্যবহারে মুগ্ধ হইত।
চরিত্রটি সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিল না। পানদোষ ছিল। প্রকাশ আছে যেযে সময়ে তিনি সুরাপান করিতেনসে সময়ে লেখনী অনর্গল কবিতা প্রসব করিত। যে কোন শ্রেণীর যে কোন পরিচিত বা অপরিচিত ব্যক্তি যে কোন সময়ে তাঁহাকে যে কোন প্রকার কবিতাগীত বা ছড়া প্রস্তুত করিয়া দিতে অনুরোধ করিততিনি আনন্দের সহিত তাঁহাদিগের আশা পূর্ণ করিতেন। কাহাকেও নিরাশ করিতেন না।
ঈশ্বরচন্দ্র পুনঃ পুনঃ আপন কবিতায় স্বীকার করিয়াছেনতিনি সুরাপান করিতেন।এক (১)* দুই (২) তিন (তিন) চারি (৪) ছেড়ে দেহ ছয় (৬)।
পাঁচেরে (৫) করিলে হাতে রিপু রিপু নয় ||তঞ্চ ছাড়া পঞ্চ সেই অতি পরিপটি।
বাবু সেজে পাটির উপরে রাখি পাটি ||পাত্র হোয়ে পাত্র পেয়ে ঢোলে মারি কাটি।
ঝোলমাখা মাছ নিয়া চাটি দিয়া চাটি ||তিনি সুরাপান করিতেনএজন্য লোকে নিন্দা করিত। তাই ঈশ্বর গুপ্ত মধ্যে মধ্যে কবিতায় তাহাদিগের উপর ঝাল ঝাড়িতেন। ঋতু কবিতার মধ্যে পাঠক এই সংগ্রহ দেখিতে পাইবেন।
যখন ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে আমার পরিচয়তখন আমি বালকস্কুলের ছাত্রকিন্তু তথাপি ঈশ্বর গুপ্ত আমার স্মৃতিপথে বড় সমুজ্জ্বল। তিনি সুপুরুষসুন্দর কান্তিবিশিষ্ট ছিলেন। কথার স্বর বড় মধুর ছিল। আমরা বালক বলিয়া আমাদের সঙ্গে নিজে একটু গম্ভীরভাবে কথাবার্তা কহিতেনতাঁহার কতকগুলা নন্দীভৃঙ্গী থাকিতরসাভাসের ভার তাহাদের উপর পড়িত। ফলে তিনি রস ব্যতীত এক দণ্ড থাকিতে পারিতেন না। স্বপ্রণীত কবিতাগুলি পড়িয়া শুনাইতে ভাল বাসিতেন। আমরা বালক হইলেও আমাদিগকেও শুনাইতে ঘৃণা করিতেন নাকিন্তু হেমচন্দ্র প্রভৃতির ন্যায় তাঁহার আবৃত্তিশক্তি পরিমার্জিত ছিল না। যাহার কিছু রচনাশক্তি আছেএমন সকল যুবককে তিনি বিশেষ উৎসাহ দিতেনতাহা পূর্বে বলিয়াছি। কবিতা রচনার জন্য দীনবন্ধুকেদ্বারকানাথ অধিকারীকে এবং আমাকে একবার প্রাইজ দেওয়াইয়াছিলেন। দ্বারকানাথ অধিকারীকৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্রতিনিই প্রথম প্রাইজ পান। তাঁহার রচনাপ্রণালীটা কতকটা ঈশ্বর গুপ্তের মত ছিলসরল স্বচ্ছদেশী কথায়দেশী ভাব তিনি ব্যক্ত করিতেন। অল্প বয়সেই তাঁহার মৃত্যু হয়। জীবিত থাকিলে বোধ হয় তিনি একজন উৎকৃষ্ট কবি হইতেন। দ্বারকানাথদীনবন্ধুঈশ্বরচন্দ্রসকলেই গিয়াছেনতাঁহাদের কথাগুলি লিখিবার জন্য আমি আছি।
সুরাপান করুনআর পাঁটার স্তোত্র লিখুনঈশ্বরচন্দ্র বিলাসী ছিলেন না। সামান্য বেশেসামান্য ভাবে অবস্থান করিতেন। যথেষ্ট অর্থ থাকিলেও ধনী ব্যক্তির উপযোগী সাজসজ্জা কিছুই করিতেন না। বৈঠকখানায় একখানি সামান্য গালিছা বা মাদুর পাতা থাকিতকোন প্রকার আসবাব থাকিত না। সম্ভ্রান্ত লোকেরা আসিয়া তাহাতে বসিয়াই ঈশ্বরের সহিত আলাপ করিয়া তৃপ্ত হইয়া যাইতেন।
————–
* (
১) কাম, (২) ক্রোধ, (৩) লোভ, (৪) মোহ, (৬) মাৎসর্য, (৫) মদ। রিপু রিপু নয়” অর্থাৎ মদ” শব্দ এখানে রিপু অর্থে বুঝিবে না।
————–
তৃতীয় পরিচ্ছেদকবিত্ব
ঈশ্বর গুপ্ত কবি। কিন্তু কি রকম কবি?ভারতবর্ষে পূর্বে জ্ঞানীমাত্রকেই কবি বলিত। শাস্ত্রবেত্তারা সকলেই কবি। ধর্মশাস্ত্রকারও কবিজ্যোতিষশাস্ত্রকারও কবি।
তার পর কবি শব্দের অর্থের অনেক রকম পরিবর্তন ঘটিয়াছে। কাব্যেষু মাঘঃ কবিঃ কালিদাসঃ” এখানে অর্থটা ইংরেজি Poet শব্দের মত। তারপর এই শতাব্দীর প্রথমাংশে কবির লড়াই” হইত। দুই দল গায়ক জুটিয়া ছন্দোবন্ধে পরস্পরের কথার উত্তর প্রত্যুত্তর দিতেন। সেই রচনার নাম কবি
আবার আজকাল কবি অর্থে Poet, তাহাকে পারা যায়কিন্তু কবিত্ব” সম্বন্ধে আজ-কাল বড় গোল। ইংরেজিতে যাহাকে Poetry বলেএখন তাহাই কবিত্ব। এখন এই অর্থ প্রচলিতসুতরাং এই অর্থে ঈশ্বর গুপ্ত কবি কি না আমরা বিচার করিতে বাধ্য।
পাঠক বোধ হয় আমার কাছে এমন প্রত্যাশা করেন নাযে এই কবিত্ব কি সামগ্রীতাহা আমি বুঝাইতে বসিব। অনেক ইংরেজ বাঙ্গালী লেখক সে চেষ্টা করিয়াছেন। তাঁহাদের উপর আমার বরাত দেওয়া রহিল। আমার এই মাত্র বক্তব্য যে সে অর্থে ঈশ্বর গুপ্তকে উচ্চাসনে বসাইতে সমালোচক সম্মত হইবেন না। মনুষ্য-হৃদয়ের কোমলগম্ভীরউন্নতঅস্ফুট ভাবগুলি ধরিয়া তাহাকে গঠন দিয়াঅব্যক্তকে তিনি ব্যক্ত করিতে জানিতেন না। সৌন্দর্যসৃষ্টিতে তিনি তাদৃশ পটু ছিলেন না। তাঁহার সৃষ্টিই বড় নাই। মধুসূদনহেমচন্দ্রনবীনচন্দ্ররবীন্দ্রনাথইঁহারা সকলেই এ কবিত্বে তাঁহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। প্রাচীনেরাও তাঁহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ভারতচন্দ্রের ন্যায় হীরামালিনী গড়িবার তাঁহার ক্ষমতা ছিল না কাশীরামের মত সুভদ্রাহরণ কি শ্রীবৎসচিন্তাকীর্তিবাসের মত তরণীসেন বধমুকুন্দরামের মত ফুল্লরা গড়িতে পারিতেন না। বৈষ্ণব কবিদের মত বীণার ঝঙ্কার দিতে জানিতেন না। তাঁহার কাব্যে সুন্দরকরুণপ্রেমএ সব সামগ্রী বড় বেশী নাই। কিন্তু তাঁহার যাহা আছেতাহা আর কাহারও নাই। আপন অধিকারের ভিতর তিনি রাজা।
সংসারের সকল সামগ্রী কিছু ভাল নহে। যাহা ভালতাও কিছু এত ভাল নহেযে তার অপেক্ষা ভাল আমরা কামনা করি না। সকল বিষয়েই প্রকৃত অবস্থার অপেক্ষা উৎকর্ষ আমরা কামনা করি। সে উৎকর্ষের আদর্শ সকলআমাদের হৃদয়ে অস্ফুট রকম থাকে। সেই আদর্শ ও সেই কামনাকবির সামগ্রী। যিনি তাহা হৃদয়ঙ্গম করিয়াছেনতাহাকে গঠন দিয়া শরীরী করিয়াআমাদের হৃদয়গ্রাহী করিয়াছেনসচরাচর তাঁহাকেই আমরা কবি বলি। মধুসূদনাদি তাহা পারিয়াছেনঈশ্বরচন্দ্র তাহা পারেন নাই বা করেন নাইএই জন্য এই অর্থে আমরা মধুসূদনাদিকে শ্রেষ্ঠ কবি বলিয়াঈশ্বরচন্দ্রকে নিম্নশ্রেণীতে ফেলিয়াছি। কিন্তু এইখানেই কি কবিত্বের বিচার শেষ হইলকাব্যের সামগ্রী কি আর কিছু রহিল না?রহিল বৈকি। যাহা আদর্শযাহা কমনীয়যাহা আকাঙ্ক্ষিততাহা কবির সামগ্রী। কিন্তু যাহা প্রকৃতযাহা প্রত্যক্ষযাহা প্রাপ্ততাহাই বা নয় কেনতাহাতে কি কিছু রস নাইকিছু সৌন্দর্য নাইআছে বৈকি। ঈশ্বর গুপ্তসেই রসে রসিকসেই সৌন্দর্যের কবি। যাহা আছেঈশ্বর গুপ্ত তাহার কবি। তিনি এই বাঙ্গালা সমাজের কবি। তিনি কলিকাতা সহরের কবি। তিনি বাঙ্গালার গ্রাম্যদেশের কবি। এই সমাজএই সহরএই দেশ বড় কাব্যময়। অন্যে তাহাতে বড় রস পান নাতোমরা পৌষপার্বণে পিটাপুলি খাইয়া অজীর্ণে দুঃখ পাওতিনি তাহার কাব্যরসটুকু সংগ্রহ করেন। অন্যে নববর্ষে মাংস চিবাইয়ামদ গিলিয়াগাঁদাফুল সাজাইয়া কষ্ট পায়ঈশ্বর গুপ্ত মক্ষিকাবৎ তাহার সারাদান করিয়া নিজে উপভোগ করেনঅন্যকেও উপহার দেন। দুর্ভিক্ষের দিনতোমরা মাতা বা শিশুর চক্ষে অশ্রবিন্দুশ্রেণী সাজাইয়া মুক্তাহারের সঙ্গে তাহার উপমা দাওতিনি চালের দরটি কষিয়া দেখিয়া তার ভিতর একটু রস পান।
মনের চেলে মন ভেঙ্গেচে
ভাঙ্গা মন আর গড়ে না কো।
তোমরা সুন্দরীগণকে পুষ্পোদ্যানে বা বাতায়নে বসাইয়া প্রতিমা সাজাইয়া পূজা করতিনি তাহাদের রান্নাঘরেউনুন গোড়ায় বসাইয়াশাশুড়ী ননদের গঞ্জনায় ফেলিয়াসত্যের সংসারের এক রকম খাঁটি কাব্যরস বাহির করেন ;—বধূর মধুর খনি। মুখশতদল।
সলিলে ভাসিয়া যায়চক্ষু ছল ছল।
ঈশ্বর গুপ্তের কাব্য চালের কাঁটায় রান্নাঘরের ধূঁয়ায়নাটুরে মাঝির ধ্বজির ঠেলায়নীলের দাদনেহোটেলের খানায়পাঁটার অস্থিস্থিত মজ্জায়। তিনি আনারসে মধুর রস ছাড়া কাব্যরস পানতপ্‌সে মাছে মৎস্যভাব ছাড়া তপস্বীভাব দেখেনপাঁটার বোকাগন্ধ ছাড়া একটু দধীচির গায়ের গন্ধ পান। তিনি বলেন, “তোমাদের এদেশএ সমাজ বড় রঙ্গভরা। তোমরা মাথা কুটাকুটি করিয়া দুর্গোৎসব করআমি কেবল তোমাদের রঙ্গ দেখিতোমরা এ ওকে ফাঁকি দিতেছএ ওর কাছে মেকি চালাইতেছএখানে কাষ্ঠ হাসি হাসওখানে মিছা কান্না কাঁদআমি তা বসিয়া বসিয়া দেখিয়া হাসি। তোমরা বলবাঙ্গালীর মেয়ে বড় সুন্দরীবড় গুণবতীবড় মনোমোহিনী-প্রেমের আধারপ্রাণের সুসারধর্মের ভাণ্ডার ;—তা হইলে হইতে পারেকিন্তু আমি দেখি উহারা বড় রঙ্গের জিনিষ। মানুষে যেমন রূপী বাঁদর পোষেআমি বলি পুরুষে তেমনি মেয়েমানুষ পোষেউভয়কেই মুখ ভেঙ্গানতেই সুখ।” স্ত্রীলোকের রূপ আছেতাহা তোমার আমার মত ঈশ্বর গুপ্তও জানিতেনকিন্তু তিনি বলেনউহা দেখিয়া মুগ্ধ হইবার কথা নহেউহা দেখিয়া হাসিবার কথা। তিনি স্ত্রীলোকের রূপের কথা পড়িলে হাসিয়া লুটাইয়া পড়েন। মাঘ মাসের প্রাতঃস্নানের সময় যেখানে অন্য কবি রূপ দেখিবার জন্যযুবতিগণের পিছে পিছে যাইতেনঈশ্বরচন্দ্র সেখানে তাহাদের নাকাল দেখিবার জন্য যান। তোমরা হয়তনেই নীহারশীতল স্বচ্ছসলিলধৌত কষিতকান্তি লইয়া আদর্শ গড়িবেতিনি বলিলেন, “দেখদেখি! কেমন তামাসাযে জাতি স্নানের সময় পধিধেয় বসন লইয়া বিব্রততোমরা তাদের পাইয়া এত বাড়াবাড়ি কর?” তোমরা মহিলাগণের গৃহকর্মে আস্থা ও যত্ন দেখিয়াবলিবে, “ধন্য স্বামিপুত্রসেবাব্রত! ধন্য স্ত্রীলোকের স্নেহ ও ধৈর্য!” ঈশ্বরচন্দ্র তখন তাহাদের হাঁড়িশালে গিয়া দেখিবেনরন্ধনের চাল চর্বণেই গেলপিটুলির জন্য কোন্দল বাধিয়া গেলস্বামীভোজন করাইবার সময়ে শাশুড়ী ননদের মুণ্ড ভোজন হইলএবং কুটুম্বভোজনের সময় লজ্জার মুণ্ড ভোজন হইল। স্থূল কথাঈশ্বর গুপ্ত Realist এবং ঈশ্বর গুপ্ত Satirist। ইহা তাঁহার সাম্রাজ্যএবং ইহাতে তিনি বাঙ্গালা সাহিত্যে অদ্বিতীয়।
ব্যঙ্গ অনেক সময় বিদ্বেষপ্রসূত। ইউরোপে অনেক ব্যঙ্গকুশল লেখক জন্মিয়াছেনতাঁহাদের রচনা অনেক সময় হিংসাঅসূয়াঅকৌশলনিরানন্দএবং পরশ্রীকাতরতা-পরিপূর্ণ। পড়িয়া বোধ হয় ইউরোপীয় যুদ্ধ ও ইউরোপীয় রসিকতা এক মার পেটে জন্মিয়াছেদুয়ের কাজ মানুষকে দুঃখ দেওয়া। ইউরোপীয় অনেক কুসামগ্রী এই দেশে প্রবেশ করিতেছেএই নরঘাতিনী রসিকতাও এদেশে প্রবেশ করিয়াছে। হুতোম পেঁচার নক্‌সা বিদ্বেষপরিপূর্ণ। ঈশ্বর গুপ্তের ব্যঙ্গে কিছুমাত্র বিদ্বেষ নাই। শত্রুতা করিয়া তিনি কাহাকেও গালি দেন না। কাহারও অনিষ্ট কামনা করিয়া কাহাকেও গালি দেন না। মেকির উপর রাগ আছে বটেতা ছাড়া সবটাই রঙ্গসবটা আনন্দ। কেবল ঘোর ইয়ারকি। গৌরীশঙ্করকে গালি দিবার সময়েও রাগ করিয়া গালি দেন না। সেটা কেবল জিগীষাব্রাহ্মণকে কুভাষার পরাজয় করিতে হইবে এই জিদ। কবির লড়াইঐ রকম শত্রুতাশূন্য গালাগালিঈশ্বর গুপ্ত কবির লড়াইয়ে” শিক্ষিতসে ধরনটা তাঁহার ছিল।
অন্যত্র তাও নাকেবল আনন্দ। যে যেখানে সমুখে পড়েতাহাকেই ঈশ্বরচন্দ্র তাহার গালে এক চড়নহে একটা কাণমলা দিয়া ছাড়িয়া দেনকারণ আর কিছুই নয়দুই জনে একটু হাসিবার জন্য। কেহই চড় চাপড় হইতে নিস্তার পাইতেন না। গবর্ণর জেনেরললেপ্টেনাণ্ট গবর্ণরকৌন্‌সিলের মেম্বর হইতেমুটেমাঝিউড়িয়া বেহারা কেহ ছাড়া নাই। এক একটি চড় চাপড় এক একটি বজ্রযে মারেতাহার রাগ নাইকিন্তু যে খায়তার হাড়ে হাড়ে লাগে। তাতে আবার পাত্রাপাত্র বিচার নাই। যে সাহসে তিনি বলিয়াছেন,—বিড়ালাক্ষী বিধুমুখীমুখে গন্ধ ছুটে।
আমাদের সে সাহস নাই। তবে বাঙ্গালীর মেয়ের উপর নীচের লিখিত দুই চরণে আমাদের ঢেরা সই রহিলসিন্দুরে বিন্দুসহ কপালেতে উল্কি।
নসী জশী ক্ষেমী বামীরামী শ্যামী গুল্‌কী ||মহারাণীকে স্তুতি করিতে করিতে দেশী Agitatorদের কাণ টানাটানিতুমি মা কল্পতরুআমরা সব পোষা গোরু,শিখি নি সিং বাঁকানো,কেবল খাব খোল বিচালি ঘাস।
যেন রাঙ্গা আমলাতুলে মামলা,গামলা ভাঙ্গে না।
আমরা ভুসি পেলেই খুসি হব,ঘুসি খেলে বাঁচব না ||সাহেব বাবুরা কবির কাছে অনেক কাণমলা খাইয়াছেনএকটা নমুনাযখন আস্‌বে শমনকরবে দমন,কি বোলে তায় বুঝাইবে।
বুঝি হুট্ বোলে বুট পায়ে দিয়ে
চুরুট ফুঁকে স্বর্গে যাবে?এক কথায়সাহেবদের নৃত্যগীতগুড়ু গুড়ু গুম গুম লাফে তাল।
তারা রারা রারা রারা লালা লালা লাল ||সখের বাবুবিনা সম্বলেতেড়া হোয়ে তুড়ি মারেটপ্পা গীত গেয়ে।
গোচে গাচে বাবু হনপচাশাল চেয়ে ||কোনরূপে পিত্তি রক্ষাএঁটোকাঁটা খেয়ে।
শুদ্ধ হন ধেনো গাঙ্গেবেনো জলে নেয়ে ||
কিন্তু অনেক স্থানেই ঈশ্বর গুপ্তের ঐ ধরন নাই। অনেক স্থানেই কেবল রঙ্গরসকেবল আনন্দ। তপ্‌সে মাছ লইয়া আনন্দকষিত কনক কান্তিকমনীয় কায়।
গালভরা গোঁপদাড়িতপস্বীর প্রায় ||মানুষের দৃশ্য নওবাস কর নীরে।
মোহন মণির প্রভাননীর শরীরে ||অথবা আনারসেলুন মেখে লেবুরসরসে যুক্ত করি।
চিন্ময়ী চৈতন্যরূপাচিনি তায় ভরি ||অথবা পাঁটাসাধ্য কার এক মুখেমহিমা প্রকাশে।
আপনি করেন বাদ্যআপনার নাশে ||হাড়কাটে ফেলে দিইধোরে দুটি ঠ্যাঙ্গ।
সে সময়ে বাদ্য করে ছ্যাড্যাঙ্গ ছ্যাড্যাঙ্গ ||এমন পাঁটার নামযে রেখেছে বোকা।
নিজে সেই বোকা নয়ঝাড়ে বংশে বোকা ||তবে ইহা স্বীকার করিতে হয়যে ঈশ্বর গুপ্ত মেকির উপর গালিগালাজ করিতেন। মেকির উপর যথার্থ রাগ ছিল। মেকি বাবুরা তাঁহার কাছে গালি খাইতেনমেকি সাহেবেরা গালি খাইতেনমেকি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা নস্যলোসা দধি চোসার” দলগালি খাইতেন। হিন্দুর ছেলে মেকি খ্রীষ্টীয়ান হইতে চলিল দেখিয়া তাঁহার রাগ সহ্য হইত না। মিশনরিদের ধর্মের মেকির উপর বড় রাগমেকি পলিটিক্‌সের উপর রাগযথাস্থানে পাঠক এ সকলের উদাহরণ পাইবেনএজন্য এখানে উদাহরণ উদ্ধৃত করিলাম না।
অনেক সময়ে ঈশ্বর গুপ্তের অশ্লীলতা এই ক্রোধসম্ভূত। অশ্লীলতা ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার একটি প্রধান দোষ। উহা বাদ দিতে গিয়া ঈশ্বর গুপ্তকে Bowdlerize করিতে গিয়াআমরা তাঁহার কবিতাকে নিস্তেজ করিয়া ফেলিয়াছি। যিনি কাব্যরসে যথার্থ রসিকতিনি আমাদিগকে নিন্দা করিবেন। কিন্তু এখনকার বাঙ্গালা লেখক বা পাঠকের যেরূপ অবস্থা তাহাতে কোনরূপেই অশ্লীলতার বিন্দুমাত্র রাখিতে পারি না। ইহাও জানি যেঈশ্বর গুপ্তের অশ্লীলতাপ্রকৃত অশ্লীলতা নহে। যাহা ইন্দ্রিয়াদির উদ্দীপনার্থ বা গ্রন্থকারের হৃদয়স্থিত কদর্যভাবের অভিব্যক্তি জন্য লিখিত হয়তাহাই অশ্লীলতা। তাহা পবিত্র সভ্যভাষায় লিখিত হইলেও অশ্লীল। আর যাহার উদ্দেশ্য সেরূপ নহেকেবল পাপকে তিরস্কৃত বা উপহসিত করা যাহার উদ্দেশ্যতাহার ভাষা রুচি এবং সভ্যতার বিরুদ্ধ হইলেও অশ্লীল নহে। ঋষিরাও এরূপ ভাষা ব্যবহার করিতেন। সেকালের বাঙ্গালীদিগের ইহা এক প্রকার স্বভাবসিদ্ধ ছিল। আমি এমন অনেক দেখিয়াছি। অশীতিপর বৃদ্ধধর্মাত্মাআজন্ম সংযতেন্দ্রিয় সভ্যসুশীলসজ্জনএমন সকল লোকওকুকাজ দেখিয়াই রাগিলেই বদ্‌জোবান” আরম্ভ করিতেন। তখনকার রাগ প্রকাশের ভাষাই অশ্লীল ছিল। ফলে সে সময়ে ধর্মাত্মা এবং অধর্মাত্মা উভয়কেই অশ্লীলতায় সুপটু দেখিতামপ্রভেদ এই দেখিতামযিনি রাগের বশীভূত হইয়া অশ্লীলতিনি ধর্মাত্মা। যিনি ইন্দ্রিয়ান্তরের বশে অশ্লীল তিনি পাপাত্মাসৌভাগ্যক্রমে সেরূপ সামাজিক অবস্থা ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হইতেছে।
ঈশ্বর গুপ্ত ধর্মাত্মাকিন্তু সেকেলে বাঙ্গালী। তাই ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা অশ্লীল। সংসারের উপরসমাজের উপরঈশ্বর গুপ্তের রাগের কারণ অনেক ছিল। সংসারবাল্যকালে বালকের অমূল্য রত্ন যে মাতাতাহা তাঁহার নিকট হইতে কাড়িয়া লইল। খাঁটি সোনা কাড়িয়া লইয়াতাহার পরিবর্তে এক পিতলের সামগ্রী দিয়া গেলমার বদলে বিমাতা। তার পর যৌবনের যে অমূল্যরত্নশুধু যৌবনের কেনযৌবনেরপ্রৌঢ় বয়সেরবার্ধক্যের তুল্যরূপেই অমূল্যরত্ন যে ভার্যা তাহার বেলাও সংসার বড় দাগা দিল। যাহা গ্রহণীয় নহেঈশ্বরচন্দ্র তাহা লইলেন নাকিন্তু দাগাবাজির জন্য সংসারের উপর ঈশ্বরের রাগটা রহিয়া গেল। তার পর অল্প বয়সে পিতৃহীনসহায়হীন হইয়াঈশ্বরচন্দ্র অন্নকষ্টে পড়িলেন। কত বানরেবানরের অট্টালিকায় শিকলে বাঁধা থাকিয়া ক্ষীর সর পায়সান্ন ভোজন করেআর তিনি দেবতুল্য প্রতিভা লইয়া ভূমণ্ডলে আসিয়াশাকান্নের অভাবে ক্ষুধার্ত। কত কুক্কুর বা মর্কট বরুষে জুড়ী জুতিয়াতাঁহার গায়ে কাদা ছড়াইয়া যায়আর তিনি হৃদয়ে বাগ্দেবী ধারণ করিয়াও খালি পায়ে বর্ষার কাদা ভাঙ্গিয়া উঠিতে পারেন না। দুর্বল মনুষ্য হইলে এ অত্যাচারে হার মানিয়ারণে ভঙ্গ দিয়াপলায়ন করিয়া দুঃখের অন্ধকার গহ্বরে লুকাইয়া থাকে। কিন্তু প্রতিভাশালীরা প্রায়ই বলবান।
ঈশ্বর গুপ্ত সংসারকে সমাজকেস্বীয় বাহুবলে পরাস্ত করিয়াতাহার নিকট হইতে ধনযশসম্মান আদায় করিয়া লইলেন। কিন্তু অত্যাচারজনিত যে ক্রোধ তাহা মিটিল না। জ্যেঠা মহাশয়ের জুতা তিনি সমাজের জন্য তুলিয়া রাখিয়াছিলেন। এখন সমাজকে পদতলে পাইয়া বিলক্ষণ উত্তম মধ্যম দিতে লাগিলেন। সেকেলে বাঙ্গালীর ক্রোধ কদর্যের উপর কদর্য ভাষাতেই অভিব্যক্ত হইত। বোধ হয় ইহাদের মনে হইতবিশুদ্ধ পবিত্র কথাদেব দেবদ্বিজাদি প্রভৃতি যে বিশুদ্ধ ও পবিত্র তাহারই ব্যবহার্যযে দুরাত্মাতাহার জন্য এই কদর্য ভাষা। এইরূপে ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় অশ্লীলতা আসিয়া পড়িয়াছে।
আমরা ইহাও স্বীকার করি যেতাহা ছাড়া অন্যবিধ অশ্লীলতাও তাঁহার কবিতায় আছে। কেবল রঙ্গদারির জন্যে শুধু ইয়ারকির জন্য এক আধটু অশ্লীলতাও আছে। কিন্তু দেশ কাল বিবেচনা করিলেতাহার জন্য ঈশ্বরচন্দ্রের অপরাধ ক্ষমা করা যায়। সে কালে অশ্লীলতা ভিন্ন কথার আমোদ ছিল না। যে ব্যঙ্গ অশ্লীল নহেতাহা সরস বলিয়া গণ্য হইত না। যে কথা অশ্লীল নহেতাহা সতেজ বলিয়া গণ্য হইত না। যে গালি অশ্লীল নহেতাহা কেহ গালি বলিয়া গণ্য করিত না। তখনকার সকল কাব্যই অশ্লীল। চোরকবিচোরপঞ্চাশৎ দুই পক্ষে অর্থ খাটাইয়া লিখিবেনবিদ্যাপক্ষে এবং কালীপক্ষেদুই পক্ষে সমান অশ্লীল। তখন পূজা পার্বণ অশ্লীলউৎসবগুলি অশ্লীলদুর্গোৎসবের নবমীর রাত্র বিখ্যাত ব্যাপার। যাত্রার সঙ অশ্লীল হইলেই লোকরঞ্জক হইত। পাঁচালি হাফআকড়াই অশ্লীলতার জন্যই রচিত। ঈশ্বর গুপ্ত সেই বাতাসের জীবন প্রাপ্ত ও বর্ধিত। অতএব ঈশ্বর গুপ্তকে আমরা অনায়াসে একটুখানি মার্জনা করিতে পারি।
আর একটা কথা আছে। অশ্লীলতা সকল সভ্যসমাজেই ঘৃণিত। তবেযেমন লোকের রুচি ভিন্ন ভিন্নতেমনি দশভেদেও রুচি ভিন্ন ভিন্ন প্রকার। এমন অনেক কথা আছেযাহা ইংরেজরা অশ্লীল বিবেচনা করেনআমরা করি না। আবার এমন কথা আছেযাহা আমরা অশ্লীল বিবেচনা করিইংরেজেরা করেন না। ইংরেজের কাছেপ্যানটালুন বা ঊরুদেশের নাম অশ্লীলইংরেজের মেয়ের কাছে সে নাম মুখে আনিতে নাই। আমরা ধুতিপায়জামা বা ঊরু শব্দগুলিকে অশ্লীল মনে করি না। মাভগিনী বা কন্যা কাহারও সম্মুখে ঐ সকল কথা ব্যবহার করিতে আমাদের লজ্জা নাই। পক্ষান্তরে স্ত্রীপুরুষে মুখচুম্বনটা আমাদের সমাজে অতি অশ্লীল ব্যাপার! কিন্তু ইংরেজের চক্ষে উহা পবিত্র কার্যমাতৃপিতৃ সমক্ষেই উহা নির্বাহ পাইয়া থাকে। এখন আমাদের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমেআমরা দেশী জিনিষ সকলই হেয় বলিয়া পরিত্যাগ করিতেছিবিলাতী জিনিষ সবই ভাল বলিয়া গ্রহণ করিতেছি। দেশী সুরুচি ছাড়িয়া আমরা বিদেশী সুরুচি গ্রহণ করিতেছি। শিক্ষিত বাঙ্গালী এমনও আছেন যেতাঁহাদের পরস্ত্রীর মুখচুম্বনে আপত্তি নাইকিন্তু পরস্ত্রীর অনাবৃত চরণ! আলতাপরা মলপরা পা! দর্শনে বিশেষ বিশেষ আপত্তি। ইহাতে আমরা যে কেবলই জিতিয়াছি এমত নহে। একটা উদাহরণের দ্বারা বুঝাই। মেঘদূতের একটি কবিতায় কালিদাস কোন পর্বতশৃঙ্গকে ধরণীর স্তন বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ইহা বিলাতী রুচিবিরুদ্ধ। স্তন বিলাতী রুচি অনুসারে অশ্লীল কথা। কাজেই এই উপমাটি নব্যের কাছে অশ্লীল। নব্যবাবু হয়ত ইহা শুনিয়া কানে আঙ্গুল দিয়া পরস্ত্রীর মুখচুম্বন ও করস্পর্শের মহিমা কীর্তনে মনোযোগ দিবেন। কিন্তু আমি ভিন্ন রকম বুঝি। আমি এ উপমার অর্থ এই বুঝি যেপৃথিবী আমাদের জননী। তাই তাঁকে ভক্তিভাবেস্নেহ করিয়া মাতা বসুমতী” বলি আমরা তাঁহার সন্তান সন্তানের চক্ষে মাতৃস্তনের অপেক্ষা সুন্দরপবিত্রজগতে আর কিছুই নাইথাকিতে পারে না। অতএব এমন পবিত্র উপমা আর হইতে পারে না। ইহাতে যে অশ্লীলতা দেখেআমার বিবেচনায় তাহার চিত্তে পাপচিন্তা ভিন্ন কোন বিশুদ্ধ ভাবের স্থান হয় না। কবি এখানে অশ্লীল নহে,—এখানে পাঠকের হৃদয় নরক। এখানে ইংরেজি রুচি বিশুদ্ধ নহেদেশী রুচিই বিশুদ্ধ।
আমাদের দেশের অনেক প্রাচীন কবিএইরূপ বিলাতী রুচির আইনে ধরা পড়িয়া বিনাপরাধে অশ্লীলতা অপরাধে অপরাধী হইয়াছেন। স্বয়ং বাল্মীকি কি কালিদাসেরও অব্যাহতি নাই। যে ইউরোপে মসুর জোলার নবেলের আদরসে ইউরোপের রুচি বিশুদ্ধআর যাঁহারা রামায়ণকুমারসম্ভব লিখিয়াছেনসীতা শকুন্তলার সৃষ্টি করিয়াছেনতাঁহাদের রুচি অশ্লীল! এই শিক্ষা আমরা ইউরোপীয়দের কাছে পাই। কি শিক্ষা! তাই আমি অনেক বার বলিয়াছিইউরোপের কাছে বিজ্ঞান ইতিহাস শিল্প শেখ। আর সব দেশীয়ের কাছে শেখ।
অন্যের ন্যায় ঈশ্বর গুপ্তও হাল আইনে অনেক স্থানে ধরা পড়েন। সে সকল স্থানে আমরা তাঁহাকে বেকসুর খালাস দিতে রাজি। কিন্তু ইহা অবশ্য স্বীকার করিতে হয় যেআর অনেক স্থানেই তত সহজে তাঁহাকে নিষ্কৃতি দেওয়া যায় না। অনেক স্থানে তাঁহার রুচি বাস্তবিক কদর্যযথার্থ অশ্লীলএবং বিরক্তিকর। তাহার মার্জনা নাই।
ঈশ্বর গুপ্তের যে অশ্লীলতার কথা আমরা লিখিলামপাঠক তাহা এ সংগ্রহে কোথাও পাইবেন নাআমরা তাহা সব কাটিয়া দিয়াকবিতাগুলিকে নেড়া মুড়া করিয়া বাহির করিয়াছি। অনেকগুলিকে কেবল অশ্লীলতাদোষ জন্যই একেবারে পরিত্যাগ করিয়াছি। তবে তাঁহার কবিতার এই দোষের এত বিস্তারিত সমালোচনা করিলামতাহার কারণ এই যেএই দোষ তাঁহার প্রসিদ্ধ। ঈশ্বর গুপ্তের কবিত্ব কি প্রকার তাহা বুঝিতে গেলেতাহার দোষ গুণ দুই বুঝাইতে হয়। শুধু তাই নয়। তাঁহার কবিত্বের অপেক্ষা আর একটা বড় জিনিষ পাঠককে বুঝাইতে চেষ্টা করিতেছি। ঈশ্বর গুপ্ত নিজে কি ছিলেনতাহাই বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছি। কবির কবিত্ব বুঝিয়া লাভ আছেসন্দেহ নাইকিন্তু কবিত্ব অপেক্ষা কবিকে বুঝিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভ। কবিতা দর্পণ মাত্রতাহার ভিতর কবির অবিকল ছায়া আছে। দর্পণ বুঝিয়া কি হইবেভিতরে যাহার ছায়াছায়া দেখিয়া তাহাকে বুঝিব। কবিতাকবির কীর্তি— তাহা ত আমাদের হাতেই আছেপড়িলেই বুঝিব। কিন্তু যিনি এই কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেনতিনি কি গুণেকি প্রকারেএই কীর্তি রাখিয়া গেলেনতাহাই বুঝিতে হইবে। তাহাই জীবনী ও সমালোচনাদত্ত প্রধান শিক্ষা ও জীবনী ও সমালোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য।
ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনীতে আমরা অবগত হইয়াছি যেএকজন অশিক্ষিত যুবা কলিকাতায় আসিয়া সাহিত্য ও সমাজে আধিপত্য সংস্থাপন করিল। কি শক্তিতেতাহাও দেখিতে পাইনিজ প্রতিভা গুণে। কিন্তু ইহা দেখিতে পাই যেপ্রতিভানুযায়ী ফল ফলে নাই। প্রভাকর মেঘাচ্ছন্ন। সে মেঘ কোথা হইতে আসিলবিশুদ্ধ রুচির অভাবে। এখন ইহা এক প্রকার স্বাভাবিক নিয়ম যেপ্রতিভা ও সুরুচি পরস্পর সখীপ্রতিভার অনুগামিনী সুরুচি। ঈশ্বর গুপ্তের বেলা তাহা ঘটে নাই নাই কেনএখানে দেশকাল পাত্র বুঝিয়া দেখিতে হইবে। তাই আমি দেশের রুচি বুঝাইলামকালের রুচি বুঝাইলামএবং পাত্রের রুচি বুঝাইলাম। বুঝাইলাম যে পাত্রের রুচির অভাবের কারণ, (১) পুস্তকদত্ত সুশিক্ষার অল্পতা, (২) মাতার পবিত্র সংসর্গের অভাব, (৩) সহধর্মিণীঅর্থাৎ যাঁহার সঙ্গে একত্রে ধর্ম শিক্ষা করিতাঁহার পবিত্র সংসর্গের অভাব, (৪) সমাজের অত্যাচার এবং তজ্জনিত সমাজের উপর কবির জাতক্রোধ। যে মেঘে প্রভাকরের তেজোহ্রাস করিয়াছিল এই সকল উপাদানে তাহার জন্ম। স্থূল তাৎপর্য এই যেঈশ্বরচন্দ্র যখন অশ্লীল তখন কুরুচির বশীভূত হইয়াই অশ্লীলভারতচন্দ্রাদির ন্যায় কোথাও কুপ্রবৃত্তির বশীভূত হইয়া অশ্লীল নহেন। তাই দর্পণতলস্থ প্রতিবিম্বের সাহায্যে প্রতিবিম্বধারী সত্তাকে বুঝাইবার জন্য আমরা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অশ্লীলতা দোষ এত সবিস্তারে সমালোচনা করিলাম। ব্যাপারটা রুচিকর নহে। মনে করিলেনমঃ নমঃ বলিয়া দুই কথায় সারিয়া যাইতে পারিতাম। অভিপ্রায় বুঝিয়া বিস্তারিত সমালোচনা পাঠক মার্জনা করিবেন।
মানুষটাকে আর একটু ভাল করিয়া বুঝা যাউককবিতা না হয় এখন থাক। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আমরা বলিয়াছি ঈশ্বর গুপ্ত বিলাসী ছিলেন না। অথচ দেখিতে পাইমুখের আটক পাটক কিছুই নাই। অশ্লীলতায় ঘোর আমোদইয়ারকি ভরাপাঁচটি স্তোত্র লেখেনতপ্‌সে মাছের মজা বুঝেনলেবু দিয়া আনারসের পরমভক্তসুরাপান* সম্বন্ধে মুক্তকণ্ঠেআবার বিলাসী কারে বলেকথাটা বুঝিয়া দেখা যাউক।
এই সংগ্রহের প্রথম খণ্ডে পাঠক ঈশ্বর গুপ্ত প্রণীত কতকগুলি নৈতিক ও পারমার্থিক বিষয়ক কবিতা পাইবেন। অনেকের পক্ষে ঐগুলি নীরস বলিয়া বোধ হইবেকিন্তু যদি পাঠক ঈশ্বর গুপ্তকে বুঝিতে চাহেনতবে সেগুলি মনোযোগপূর্বক পাঠ করিবেন। দেখিবেন সেগুলি ফরমায়েশি কবিতা নহে। কবির আন্তরিক কথা তাহাতে আছে। অনেকগুলির মধ্যে ঐ কয়টি বাছিয়া দিয়াছিআর বেশী দিলে রসিক বাঙ্গালী পাঠকের বিরক্তিকর হইয়া উঠিবে। ইহা বলিলেই যথেষ্ট হইবেযে পরমার্থ বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র গদ্যে পদ্যে যত লিখিয়াছেনএত আর কোন বিষয়েই বোধ হয় লিখেন নাই। এ গ্রন্থ পদ্যসংগ্রহ বলিয়াআমরা তাঁহার গদ্য কিছুই উদ্ধৃত করি নাইকিন্তু সে গদ্য পড়িয়া বোধ হয়যে পদ্য অপেক্ষাও বুঝি গদ্যে তাঁহার মনের ভাব আরও সুস্পষ্ট। এই সকল গদ্য পদ্যে প্রণিধান করিয়া দেখিলেআমরা বুঝিতে পারিব যেঈশ্বর গুপ্তের ধর্মএকটা কৃত্রিম ভান ছিল না। ঈশ্বরে তাঁর আন্তরিক ভক্তি ছিল। তিনি মদ্যপ হউনবিলাসী হউনকোন হবিষ্যাশী নামাবলীধারীতে সেরূপ আন্তরিক ঈশ্বরে ভক্তি দেখিতে পাই না। সাধারণ ঈশ্বরবাদী বা ঈশ্বরভক্তের মত তিনি ঈশ্বরবাদী ও ঈশ্বরভক্ত ছিলেন না। তিনি ঈশ্বরকে নিকটে দেখিতেনযেন প্রত্যক্ষ দেখিতেনযেন মুখোমুখী হইয়া কথা কহিতেন। আপনাকে যথার্থ ঈশ্বরের পুত্রঈশ্বরকে আপনার সাক্ষাৎ মূর্তিমান পিতা বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস করিতেন। মুখামুখী হইয়া বাপের সঙ্গে বচসা করিতেন। কখন বাপের আদর খাইবার জন্য কোলে বসিতে যাইতেনআপনি বাপকে কত আদর করিতেনউত্তর না পাইলে কাঁদাকাটা বাধাইতেন। বলিতে কিতাঁহার ঈশ্বরের গাঢ় পুত্রবৎ অকৃত্রিম প্রেম দেখিয়া চক্ষের জল রাখা যায় না। অনেক সময়েই দেখিতে পাইযে মূর্তিমান ঈশ্বর সম্মুখে পাইতেছেন নাকথার উত্তর পাইতেছেন না বলিয়াতাঁহার অসহ্য যন্ত্রণা হইতেছেবাপকে বকিয়া ফাটাইয়া দিতেছেন। বাপ নিরাকার নির্গুণ চৈতন্য মাত্রসাক্ষাৎ মূর্তিমান বাপ নহেনএ কথা মনে করিতেও অনেক সময়ে কষ্ট হইত। #
——————
সুরাপানের মার্জনা নাই। মার্জনার আমিও কোন কারণ দেখিতে ইচ্ছুক নহি। কেবল সে সম্বন্ধে পাঠককে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ কবির এই উক্তিটি স্মরণ করিতে বলি-
একোহি দোষো গুণসন্নিপাতে নিমজ্জতীন্দোঃ কিরণেষ্বিবাঙ্কঃ।
কবিতাসংগ্রহের ৫৯ পৃষ্ঠার কবিতাটি পাঠ কর।
——————
কাতর কিঙ্কর আমিতোমার সন্তান।
আমার জনক তুমিসবার প্রধান ||বার বার ডাকিতেছিকোথা ভগবান্।
একবার তাহে তুমিনাহি দাও কান ||সর্বদিকে সর্বলোকেকত কথা কয়।
শ্রবণে সে সব রবপ্রবেশ না হয় ||হায় হায় কব কায়মটিল কি জ্বালা।।
জগতের পিতা হোয়েতুমি হলে কালা ||মনে সাধ কথা কইনিকটে আনিয়া।
অধীর হলেম ভেবেবধির জানিয়া ||
এ ভক্তের স্তুতি নহেএ বাপের উপর বেটার অভিমান। ধন্য ঈশ্বরচন্দ্রতুমি পিতৃপদ লাভ করিয়াছ সন্দেহ নাই। আমরা কেহই তোমার সমালোচক হইবার যোগ্য নহি।
ঈশ্বরচন্দ্রের ঈশ্বরভক্তির যথার্থ স্বরূপ যিনি অনুভূত করিতে চানভরসা করি তিনি এই সংগ্রহের উপর নির্ভর করিবেন না। এ সংগ্রহ সাধারণের আয়ত্ত ও পাঠ্য করিবার জন্য ইহা নানা দিকে সঙ্কীর্ণ করিতে আমি বাধ্য হইয়াছি। ঈশ্বর সম্বন্ধীয় কতকগুলি গদ্য পদ্য প্রবন্ধ মাসিক প্রভাকরে প্রকাশিত হয়যিনি পাঠ করিবেনতিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের অকৃত্রিম ঈশ্বরভক্তি বুঝিতে পারিবেন। সেগুলি যাহাতে পুনর্মুদ্রিত হয়সে যত্ন পাইব।
বৈষ্ণবগণ বলেনহনুমানাদি দাস্যভাবেশ্রীদামাদি সখ্যভাবেনন্দযশোদা পুত্রভাবেএবং গোপীগণ কান্তভাবে সাধনা করিয়া ঈশ্বর পাইয়াছিলেন। কিন্তু পৌরাণিক ব্যাপার সকল আমাদিগের হইতে এতদূর সংস্থিতযে তদালোচনা আমাদের যাহা লভনীয়তাহা আমরা বড় সহজে পাই না। যদি হনুমানউদ্ধবযশোদা বা শ্রীরাধাকে আমাদের কাছে পাইতামতবে সে সাধনা বুঝিবার চেষ্টা কতক সফল হইত। বাঙ্গালার দুই জন সাধকআমাদের বড় নিকট। দুই জনই বৈদ্যদুই জনই কবি। এক রামপ্রসাদ সেনআর এক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। ইঁহারা কেহই বৈষ্ণব ছিলেন নাকেহই ঈশ্বরকে প্রভুসখাপুত্রবা কান্তভাবে দেখেন নাই। রামপ্রসাদ ঈশ্বরকে সাক্ষাৎ মাতৃভাবে দেখিয়া ভক্তি সাধিত করিয়াছিলেনঈশ্বরচন্দ্র পিতৃভাবে। রামপ্রসাদের মাতৃপ্রেমে আর ঈশ্বরচন্দ্রের পিতৃপ্রেমে ভেদ বড় অল্প।
তুমি হে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত ত্রিসংসার।
আমি হে ঈশ্বর গুপ্ত কুমার তোমার ||পিতৃ নামে নাম পেয়েউপাধি পেয়েছি।
জন্মভূমি জননীর কোলেতে বসেছি ||তুমি গুপ্ত আমি গুপ্তগুপ্ত কিছু নয়।
তবে কেন গুপ্ত ভাবে ভাব গুপ্ত রয়?
পুনশ্চআরও নিকটে
তোমার বদনে যদিনা সরে বচন।
কেমনে হইবে তবেকথোপকথন ||আমি যদি কিছু বলিবুঝে অভিপ্রায়।
ইসেরায় ঘাড় নেড়েসায় দিও তায় ||
যার এই ঈশ্বরভক্তিযে ঈশ্বরকে এইরূপ সর্বদা নিকটেঅতি নিকটে দেখেঈশ্বরসংসর্গতৃষ্ণায় যাহার হৃদয় এইরূপে দগ্ধসে কি বিলাসী হইতে পারেহয় হউক। আমরা এরূপ বিলাসী ছাড়িয়া সন্ন্যাসী দেখিতে চাই না।
তবে ঈশ্বর সন্ন্যাসীহবিষ্যাশী বা অভোক্তা ছিলেন না। পাঁটাতপ্‌সে মাছবা আনারসের গুণ গায়িতে ও রসাস্বাদনেউভয়েই সক্ষম ছিলেন। যদি ইহা বিলাসিতা হয়তিনি বিলাসী ছিলেন। তাঁহার বিলাসিতা তিনি নিজে স্পষ্ট করিয়া বর্ণনা করিয়াছেন;—
লক্ষ্মীছাড়া যদি হওখেয়ে আর দিয়ে।
কিছুমাত্র সুখ নাইহেন লক্ষ্মী নিয়ে ||যতক্ষণ থাকে ধনতোমার আগারে।
নিজে খাওখেতে দাওসাধ্য অনুসারে ||ইথে যদি কমলারমন নাহি সরে
প্যাঁচা লয়ে যান মাতাকৃপণের ঘরে ||
শাকান্নমাত্র যে ভোজন না করেতাহাকেই বিলাসী মধ্যে গণনা করিতে হইবেইহাও আমি স্বীকার করি না। গীতায় ভগবদুক্তি এই
আয়ুঃসত্ত্বলারোগ্য সুখপ্রীতিতবিবর্ধনাঃ।
স্নিগ্ধারস্যাস্থিরাহৃদ্যাঃ আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ।
স্থূল কথা এইযাহা আগে বলিয়াছিঈশ্বর গুপ্ত মেকির বড় শত্রু। মেকি মানুষের শত্রুএবং মেকি ধর্মের শত্রু। লোভী পরদ্বেষী অথচ হবিষ্যাশী ভণ্ডের ধর্ম তিনি গ্রহণ করেন নাই। ভণ্ডের ধর্মকে ধর্ম বলিয়া তিনি জানিতেন না। তিনি জানিতেন ধর্ম ঈশ্বরানুরাগেআহার ত্যাগে নহে। যে ধর্মে ঈশ্বরানুরাগ ছাড়িয়া পানাহারত্যাগকে ধর্মের স্থানে খাড়া করিতে চাহিততিনি তাহার শত্রু। সেই ধর্মের প্রতি বিদ্বেষবশতঃ পাঁটার স্তোত্রআনারসের গুণগানেএবং তপ্‌সের মহিমা বর্ণনায় কবির এত সুখ হইত। মানুষটা বুঝিলামনিজে ধার্মিকধর্মে খাঁটিমেকির উপর খড়্গহস্ত। ধার্মিকের কবিতায় অশ্লীলতায় কেন দেখিবোধ হয় তাহা বুঝিয়াছি। বিলাসিতা কেন দেখিবোধ হয় তাহা এখন বুঝিলাম।
ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার কথা বলিতে বলিতে তাঁহার ব্যঙ্গের কথায়ব্যঙ্গের কথা হইতে তাঁহার অশ্লীলতার কথায়অশ্লীলতার কথা হইতে তাঁহার বিলাসিতার কথায় আসিয়া পড়িয়াছিলাম। এখন ফিরিয়া যাইতে হইতেছে।
অশ্লীলতা যেমন তাঁহার কবিতার এক প্রধান দোষশব্দাড়ম্বরপ্রিয়তা তেমনি আর এক প্রধান দোষ। শব্দচ্ছটায়অনুপ্রাস যমকের ঘটায়তাঁহার ভাবার্থ অনেক সময়ে একেবারে ঘুচিয়া মুছিয়া যায়। অনুপ্রাস যমকের অনুরোধে অর্থের ভিতর কি ছাই ভস্ম থাকিয়া যায়কবি তাহার প্রতি কিছুমাত্র অনুধাবন করিতেছেন নাদেখিয়া সময়ে রাগ হয়দুঃখ হয়হাসি পায়দয়া হয়পড়িতে আর প্রবৃত্তি হয় না। যে কারণে তাঁহার অশ্লীলতাসেই কারণে এই যমকানুপ্রাসে অনুরাগ দেশ কাল পাত্র। সংস্কৃত সাহিত্যের অবনতির সময় হইতে যমকানুপ্রাসের বড় বাড়াবাড়ি। ঈশ্বর গুপ্তের পূর্বেইকবিওয়ালার কবিতায়পাঁচালিওয়ালার পাঁচালিতেইহার বেশী বাড়াবাড়ি। দাশরথি রায় অনুপ্রাস যমকে বড় পটুতাই তাঁর পাঁচালি লোকের এত প্রিয় ছিল। দাশরথি রায়ের কবিত্ব না ছিলএমন নহেকিন্তু অনুপ্রাস যমকের দৌরাত্ম্যে তাহা প্রায় একেবারে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে পাঁচালিওয়ালা ছাড়িয়া তিনি কবির শ্রেণীতে উঠিতে পান নাই। এই অলঙ্কার প্রয়োগে পটুতায় ঈশ্বর গুপ্তের স্থান তার পরেএত অনুপ্রাস যমক আর কোন বাঙ্গালীতে ব্যবহার করে না। এখানেও মার্জিত রুচির অভাব জন্য বড় দুঃখ হয়।
অনুপ্রাস যমক সর্বত্রই দুষ্য এমন কথা আমি বলি না। ইংরেজিতে ইহা বড় কদর্য শুনায় বটেকিন্তু সংস্কৃতে ইহার উপযুক্ত ব্যবহার অনেক সময়েই বড় মধুর। কিছুরই বাহুল্য ভাল নহেঅনুপ্রাস যমকের বাহুল্য বড় কষ্টকর। রাখিয়া ঢাকিয়াপরিমিত ভাবে ব্যবহার করিতে পারিলে বড় মিঠে। বাঙ্গালাতেও তাই। মধুসূদন দত্ত মধ্যে মধ্যে অনুপ্রাসের ব্যবহার করেন,—বড় বুঝিয়া সুঝিয়ারাখিয়া ঢাকিয়াব্যবহার করেনমধুর হয়। শ্রীমান্ অক্ষয়চন্দ্র সরকার গদ্যে কখন কখনদুই এক বুঁদ অনুপ্রাস ছাড়িয়া দেনরস উছলিয়া উঠে। ঈশ্বর গুপ্তেরও এক একটি অনুপ্রাস বড় মিঠেবিবিজান চলে জান লবেজান করে।
ইহার তুলনা নাই। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের সময় অসময় নাইবিষয় অবিষয় নাইসীমা সরহদ্দ নাইএকবার অনুপ্রাস যমকের ফোয়ারা খুলিলে আর বন্ধ হয় না। আর কোন দিকে দৃষ্টি থাকে নাকেবল শব্দের দিকে। এরূপ শব্দ ব্যবহারে তিনি অদ্বিতীয়। তিনি শব্দের প্রতিযোগীশূন্য অধিপতি। এই দোষ গুণের উদাহরণস্বরূপ দুইটি গীত বোধেন্দুবিকাশ হইতে উদ্ধৃত করিলাম।
রাগিণী বেহাগতাল একতালা।
কে রেবামাবারিদবরণী,তরুণীভালেধরেছে তরণি,কাহারো ঘরণীআসিয়ে ধরণীকরিছে দনুজ জয়।
হেয় হে ভূপকি অপরূপঅনুপ রূপনাহি স্বরূপ,মদননিধনকরণকারণচরণ শরণ লয় ||বামাহাসিছেভাষিছেলাজ না বাসিছে,হুঙ্কার রবেবিপক্ষ নাশিছেগ্রাসিছে বারণহয়। ১
বামাটলিছে ঢলিছেলাবণ্য গলিছে,সঘনে বলিছেগগনে চলিছে,কোপেতে জ্বলিছেদনুজ দলিছেছলিছে ভুবনময় || 
কে রেললিতরসনাবিকটদশনা,করিয়ে ঘোষণাপ্রকাশে বাসনা,হয়ে শবাসনাবামা বিবসনাআসবে মগনা রয়। ৩
রাগিণী বেহাগতাল একতালা।
কে রেবামাষোড়শী রূপসী,সুরেশীযেনহে মানুষী,ভালে শিশুশশীকরে শোভে অসিরূপমসীচারু ভাস।
দেখবাজিছেঝম্পদিতেছে ঝম্প,মারিছে লম্ফহতেছে কম্প,গেল রে পৃথ্বীকরে কি কীর্তিচরণে কৃত্তিবাস || 
কে রেকরাল-কামিনীমরালগামিনী,কাহার স্বামিনীভুবনভামিনী,রূপেতে প্রভাতকরেছে যামিনী দামিনীজড়িত-হাস। ২
কে রেযোগিনী সঙ্গেরুধির-রঙ্গে,রণতরঙ্গেনাচে ত্রিভঙ্গে,কুটিলাপাঙ্গেতিমির-অঙ্গেকরিছে তিমির নাশ। ৩
আহাযে দেখি পর্বযে ছিল গর্ব,হইল খর্বগেল রে সর্ব,চরণসরোজেপড়িয়ে শর্বকরিছে সর্বনাশ। ৪
দেখিনিকট মরণকর রে স্মরণ,মরণহরণঅভয় চরণ
নিবিড় নবীন নীরদবরণমানসে কর প্রকাশ। ৫
ঈশ্বর গুপ্ত অপূর্ব শব্দকৌশলী বলিয়াতাঁহার যেমন এই গুরুতর দোষ জন্মিয়াছেতিনি অপূর্ব শব্দকৌশলী বলিয়া তেমনি তাঁহার এক মহৎ গুণ জন্মিয়াছেযখন অনুপ্রাস যমকে মন না থাকেতখন তাঁহার বাঙ্গালা ভাষা সাহিত্যে অতুল। যে ভাষায় তিনিপদ্য লিখিয়াছেনএমন খাঁটি বাঙ্গালায়এমন বাঙ্গালীর প্রাণের ভাষায়আর কেহ পদ্য কি গদ্য কিছুই লেখে নাই। তাহাতে সংস্কৃতজনিত কোন বিকার নাইইংরেজি-নবিশীর বিকার নাই। পাণ্ডিত্যের অভিমান নাইবিশুদ্ধির বড়াই নাই। ভাষা হেলে নাটলে নাবাঁকে নাসরলসোজা পথে চলিয়া গিয়া পাঠকের প্রাণের ভিতর প্রবেশ করে। এমন বাঙ্গালীর বাঙ্গালা ঈশ্বর গুপ্ত ভিন্ন আর কেহই লেখে নাইআর লিখিবার সম্ভাবনা নাই। কেবল ভাষা নহেভাবও তাই। ঈশ্বর গুপ্ত দেশী কথাদেশী ভাব প্রকাশ করেন। তাঁর কবিতায় কেলা কা ফুল নাই।
ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা প্রচারের জন্য আমরা যে উদ্যোগীতাহার বিশেষ কারণ তাঁহার ভাষার এই গুণ। খাঁটি বাঙ্গালা আমাদিগের বড় মিঠে লাগেভরসা করি পাঠকেরও লাগিবে। এমন বলিতে চাই নাযে ভিন্ন ভাষার সংস্পর্শে ও সংঘর্ষে বাঙ্গালা ভাষার কোন উন্নতি হইতেছে না বা হইবে না। হইতেছে ও হইবে। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষা যাহাতে জাতি হারাইয়া ভিন্ন ভাষার অনুকরণ মাত্রে পরিণত হইয়া পরাধীনতা প্রাপ্ত না হয় তাহাও দেখিতে হয়। বাঙ্গালা ভাষা বড় দোটানার মধ্যে পড়িয়াছে। ত্রিপথগামিনী এই স্রোতস্বতীর ত্রিবেণীর মধ্যে আবর্তে পড়িয়া আমরা ক্ষুদ্র লেখকেরা অনেক ঘুরপাক খাইতেছি। একদিকে সংস্কৃতের স্রোতে মরা গাঙ্গে উজান বহিতেছেকত ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রাড়্‌বিবাক্ মলিম্লুচ” গুণ ধরিয়া সেকেলে বোঝাই নৌকা সকল টানিয়া উঠাইতে পারিতেছে নাআর একদিকে ইংরেজির ভরা গাঙ্গে বেনোজল ছাপাইয়া দেশ ছারখার করিয়া তুলিয়াছেমাধ্যাকর্ষণযবক্ষারজানইবোলিউশনডিবলিউশন প্রভৃতি জাহাজপিনেসবজরাক্ষুদে লঞ্চের জ্বালায় দেশ উৎপীড়িতমাঝে স্বচ্ছসলিলা পুণ্যতোয়া কৃশাঙ্গী এই বাঙ্গালা ভাষার স্রোতঃ বড় ক্ষীণ বহিতেছে। ত্রিবেণীর আবর্তে পড়িয়া লেখক পাঠক তুল্যরূপেই ব্যতিব্যস্ত। এ সময়ে ঈশ্বর গুপ্তের রচনার প্রচারে কিছু উপকার হইতে পারে।
ঈশ্বর গুপ্তের আর এক গুণতাঁহার কৃত সামাজিক ব্যাপারে সকলের বর্ণনা অতি মনোহর। তিনি যে সকল রীতি নীতি বর্ণিত করিয়াছেনতাহা অনেক বিলুপ্ত হইয়াছে বা হইতেছে। সে সকল পাঠকের নিকট বিশেষ আদরণীয় হইবেভরসা করি।
ঈশ্বর গুপ্তের স্বভাব বর্ণনা নবজীবনে বিশেষ প্রকারে প্রশংসিত হইয়াছে। আমরা ততটা প্রশংসা করি না। ফলে তাঁহার যে বর্ণনার শক্তি ছিল তাহার সন্দেহ নাই। তাহার উদাহরণ এই সংগ্রহে পাঠক মধ্যে মধ্যে দেখিতে পাইবেন। বর্ষাকালের নদী”, “প্রভাতের পদ্ম” প্রভৃতি কয়েকটি প্রবন্ধে তাহার পরিচয় পাইবেন।
স্থূল কথা তাঁর কবিতার অপেক্ষা তিনি অনেক বড় ছিলেন। তাঁহার প্রকৃত পরিচয় তাঁহার কবিতায় নাই। যাঁহারা বিশেষ প্রতিভাশালী তাঁহার প্রায় আপন সময়ের অগ্রবর্তী। ঈশ্বর গুপ্ত আপন সময়ের অগ্রবর্তী ছিলেন। আমরা দুই একটা উদাহরণ দিই।
প্রথমদেশবাৎসল্য। বাৎসল্য পরমধর্মকিন্তু এ ধর্ম অনেক দিন হইতে বাঙ্গালা দেশের ছিল না। কখনও ছিল কি না বলিতে পারি না। এখন ইহা সাধারণ হইতেছেদেখিয়া আনন্দ হয়কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের সময়েইহা বড়ই বিরল ছিল। তখনকার লোকে আপন আপন সমাজআপন আপন জাতিবা আপন আপন ধর্মকে ভালবাসিতইহা দেশবাৎসল্যের ন্যায় উদার নহেঅনেক নিকৃষ্ট। মহাত্মা রামমোহন রায়ের কথা ছাড়িয়া দিয়া রামগোপাল ঘোষ ঐ হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে বাঙ্গালা দেশে দেশবাৎসল্যের প্রথম নেতা বলা যাইতে পারে। ঈশ্বর গুপ্তের দেশবাৎসল্য তাঁহাদিগেরও কিঞ্চিৎ পূর্বগামী। ঈশ্বর গুপ্তের দেশবাৎসল্য তাঁহাদের মত ফলপ্রদ না হইয়াও তাঁহাদের অপেক্ষাও তীব্র ও বিশুদ্ধ। নিম্ন কয় ছত্র পদ্য ভরসা করি সকল পাঠকই মুখস্থ করিবেন,—
ভ্রাতৃভাব ভাবি মনেদেখ দেশবাসিগণে,প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।
কতরূপ স্নেহ করিদেশের কুকুর ধরি,বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া ||
তখনকার লোকের কথা দূরে থাকএখনকার কয়জন ইহা বুঝেএখনকার কয়জন লোক এখানে ঈশ্বর গুপ্তের সমকক্ষঈশ্বর গুপ্তেরকথায় যা কাজেও তাই ছিল। তিনি বিদেশের ঠাকুরদিগের প্রতি ফিরিয়াও চাহিতেন নাদেশের কুকুর লইয়াও আদর করিতেন। ২৮৪ পৃষ্ঠায় মাতৃভাষা সম্বন্ধে যে কবিতাটি আছেপাঠককে তাহা পড়িতে বলি। মাতৃসম মাতৃভাষা” সৌভাগ্যক্রমে এখন অনেকে বুঝিতেছেনকিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের সময়ে কে সাহস করিয়া এ কথা বলে? “বাঙ্গালা বুঝিতে পারি,” এ কথা স্বীকার করিতে অনেকের লজ্জা হইত। আজিও না কি কলিকাতায় এমন অনেক কৃতবিদ্য নরাধম আছেযাহারা মাতৃভাষাকে ঘৃণা করেযে তাহার অনুশীলন করেতাহাকেও ঘৃণা করেএবং আপনাকে মাতৃভাষা অনুশীলনে পরাঙ্মুখ ইংরেজিনবীশ বলিয়া পরিচয় দিয়াআপনার গৌরব বৃদ্ধির চেষ্টা পায়। যখন এই মহাত্মারা সমাজে আদৃততখন এ সমাজ ঈশ্বর গুপ্তের সমকক্ষ হইবার অনেক বিলম্ব আছে।
দ্বিতীয়ধর্ম। ঈশ্বর গুপ্ত ধর্মেও সমকালিক লোকদিগের অগ্রবর্তী ছিলেন। তিনি হিন্দু ছিলেনকিন্তু তখনকার লোকদিগের ন্যায় উপধর্মকে হিন্দুধর্ম বলিতেন না। এখন যাহা বিশুদ্ধ হিন্দুধর্ম বলিয়া শিক্ষিত সম্প্রদায়ভুক্ত অনেকেই গৃহীত করিতেছেনঈশ্বর গুপ্ত সেই বিশুদ্ধপরম মঙ্গলময় হিন্দুধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। সেই ধর্মের যথার্থ মর্ম কি তাহা অবগত হইবার জন্যতিনি সংস্কৃতে অনভিজ্ঞ হইয়াও অধ্যাপকের সাহায্যে বেদান্তাদি দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছিলেনএবং বুদ্ধির অসাধারণ প্রাখর্যহেতু সে সকলে যে তাঁহার বেশ অধিকার জন্মিয়াছিলতাঁহার প্রণীত গদ্যে পদ্যে তাহা বিশেষ জানা যায়। এক সময়ে ঈশ্বর গুপ্ত ব্রাহ্ম ছিলেন। আদিব্রাহ্মসমাজভুক্ত ছিলেনএবং তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্য ছিলেন। ব্রাহ্মদিগের সঙ্গে সমবেত হইয়া বক্তৃতাউপাসনাদি করিতেন। এ জন্য শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট তিনি পরিচিত ছিলেন এবং আদৃত হইতেন।
তৃতীয়। ঈশ্বর গুপ্তের রাজনীতি বড় উদার ছিল। তাহাতেও যে তিনি সময়ের অগ্রবর্তী ছিলেনসে কথা বুঝাইতে গেলে অনেক কথা বলিতে হয়সুতরাং নিরস্ত হইলাম।
এক্ষণে এই সংগ্রহ সম্বন্ধে দুই একটা কথা বলিয়া আমি ক্ষান্ত হইব। ঈশ্বর গুপ্ত যত পদ্য লিখিয়াছেনএত আর কোন বাঙ্গালী লেখে নাই। গোপাল বাবুর অনুমানতিনি প্রায় পঞ্চাশ হাজার ছত্র পদ্য লিখিয়াছেন। এখন যাহা পাঠককে উপহার দেওয়া যাইতেছেতাহা উহার ক্ষুদ্রাংশ। যদি তাঁহার প্রতি বাঙ্গালী পাঠকসমাজের অনুরাগ দেখা যায়তবে ক্রমশঃ আরও প্রকাশ করা যাইবে। এ সংগ্রহ প্রথম খণ্ড মাত্র। বাছিয়া বাছিয়া সর্বোৎকৃষ্ট কবিতাগুলি যে ইহাতে সন্নিবেশিত করিয়াছি এমন নহে। যদি সকল ভাল কবিতাগুলিই প্রথম খণ্ডে দিবতবে অন্যান্য খণ্ডে কি থাকিবে?নির্বাচনকালে আমার এই লক্ষ্য ছিলযেঈশ্বর গুপ্তের রচনার প্রকৃতি কিযাহাতে পাঠক বুঝিতে পারেনতাহাই করিব। এজন্যকেবল আমার পছন্দ মত কবিতাগুলি না তুলিয়া সকল রকমের কবিতা কিছু কিছু তুলিয়াছি। অর্থাৎ যত রকম রচনা-প্রথা ছিলসকল রকমের কিছু কিছু উদাহরণ দিয়াছি। কেবল যাহা অপাঠ্য তাহারই উদাহরণ দিই নাই। আর হিতপ্রভাকর”, “বোধেন্দুবিকাশ”, “প্রবোধপ্রভাকর”, প্রভৃতি গ্রন্থ হইতে কিছু সংগ্রহ করি নাই। কেন না সেই গ্রন্থগুলি অবিকল পুনর্মুদ্রিত হইবার সম্ভাবনা আছে। তদ্ভিন্ন তাঁহার গদ্য রচনা হইতে কিছুই উদ্ধৃত করি নাই। ভরসা করিতাহার স্বতন্ত্র এক খণ্ড প্রকাশিত হইতে পারিবে।
পরিশেষে বক্তব্য যেঅনবকাশ-বিদেশে বাস প্রভৃতি কারণে আমি মুদ্রাঙ্কনকার্যের কোন তত্ত্বাবধান করিতে পারি নাই। তাহাতে যদি দোষ হইয়া থাকেতবে পাঠক মার্জনা করিবেন।

BENGALI SELECTIONS
Appointed by the syndicate of the Calcutta University for the Entrance Examination, 1895.
PREFACE
One of the objects kept in view in this compilation has been to place before the student as great a variety of style as is possible in a small volume like the present, I have admitted on this ground, a few short extracts from the older poets, whose quaint and now antiquated style is as superior to that of their modern successors in vigour and richness, as it is inferior to it in elegance and refinement.
I have also taken care that the matter should be equally varied, and should enable the young student to form some idea of ancient as well as modern Hindu thought and culture. The passage specially translated from the Mahabharata, Pandit Iswar Chandra Vidyasagar’s beautiful renderings from Kalidasa, Babu Bhudeb Mukherjee’s masterly studies of modern Bengali life, and Babu Rajkrishna Mukherjee’s lucid expositions of the most advanced European thought in his singularly charming style, will present the student with reading as varied as useful, and with instruction which, although almost indispensably necessary to him, he cannot expect to obtain from his English text-books. There are many who do not accept the views put forward in some of these extracts, but it is impossible to find anything in Bengali literature, or in any literature, to which all parties will subscribe. The best way of training the minds of young men is not to restrict them to any particular groove of thought. Among the results of education, scarcely anything is more valuable than the capacity to consider questions that arise from different and even opposite points of view. I have not therefore thought it proper to confine the extracts to what will meet with universal acceptance, to the exclusion of what will best benefit the student.
A word about Grammar, Bengali Grammar is still in some respects in an unsettled state. Purists insist on a rigid adherence to the rules of Sanskrit Grammar in all cases to which they can be made applicable, while others contened that whatever is sanctioned by the usage of the best writers is admissible. In the present volume I have allowed each writer to retain his own grammar, confining my own duty as Editor to the correction of obvious errors and misprints.
I have admitted extracts from my own writing with some reluctance. They had a place in all previous selection ; their exclusion now for the first time would have required some explanation, and I had none to offer.
The student will probably find the present volume of selections more difficult than any of its predecessors. But students who do not take the trouble of acquiring a classical language must be prepared to give to their own vernacular, more time and attention than they have hitherto done. They have hitherto, enjoyed an unfair advantage over those who take up a classical language, and they must not complain now that the balance is sought to be redressed.
BANKIM CHANDRA CHATTERJEE.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন